বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতে বর্তমানে যে সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার একটি বড় উদাহরণ হলো বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, সালমান এফ রহমান এবং তার গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলি প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ আত্মসাৎ করেছে। শুধু তাই নয়, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, যার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এবং অর্থনীতি এখন বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি।বিএফআইইউ এর প্রতিবেদন অনুসারে, সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে নেওয়া ঋণের একটি বড় অংশ জনতা ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংক থেকে এসেছে। জনতা ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার পর, এর প্রায় ২২ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা ব্যাংকিং সিস্টেমের জন্য এক বড় ক্ষতির কারণ। আইএফআইসি ব্যাংক থেকেও তিনি ১৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন, যেটির মধ্যে একাধিক ভূয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না, এবং এগুলোর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মূলত একটি অবৈধ এবং অবাঞ্চিত কার্যক্রম।এই ঋণের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এমনভাবে ঋণ বিতরণের ঘটনা শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দুর্বলই করেনি, দেশের আর্থিক খাতের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।সালমান এফ রহমান টাকা পাচারের জন্য বিশেষভাবে ‘একমোডেশন বিল’ এবং ‘পাতানো বিল’-এর ব্যবহার করেছেন। তিনি আরআর গ্লোবাল ট্রেডিং এফজেডই নামে একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করেছেন, যা কখনো আমদানিকারক, আবার কখনো রপ্তানিকারক হিসেবে কাজ করেছে। এর মাধ্যমে ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার (৪ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা) বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই অর্থ পাচারের কৌশল এতটাই সুকৌশলে পরিকল্পিত যে, বিষয়টি তদন্ত করার জন্য সঠিক নজরদারি এবং তদন্তের অভাব রয়েছে। এর ফলে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা পুরোপুরি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।জনতা ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংকের মতো বড় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তা পুরোপুরি খেলাপি হয়ে গেছে। অর্থাৎ, ৫৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি, যা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এই খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, এবং এর প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়তে পারে।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, সালমান এফ রহমানের এসব অপরাধ শুধুমাত্র ব্যাংকিং খাতের জন্য নয়, বরং পুরো দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, অর্থ পাচারের অভ্যন্তরীণ গোপনীয়তা, এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে। বিশেষত, যেহেতু এসব অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, সেহেতু এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।এছাড়া, দেশের বিনিয়োগকারীরা যদি এই ধরনের দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার অভাব দেখতে পান, তবে তাদের আস্থা সংকুচিত হবে। যার ফলে, ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহও বন্ধ হয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আরও বিপজ্জনক হতে পারে।সরকারের কাছে এখন একটি কঠিন পরীক্ষা। সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে, দেশের অর্থনীতির সংকট আরও গভীর হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, সরকারের দুর্বলতা এবং আর্থিক খাতে যথাযথ তৎপরতার অভাবই এই ধরনের দুর্নীতি এবং লুটপাটকে সম্ভব করেছে। সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে, এমন আরো অনেক দুর্নীতিবাজ আর্থিক রাঘববোয়াল দেশকে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে যাবে।দেশের ব্যাংকিং খাত, অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামোতে যে বিপর্যয় ঘটেছে, তা অগ্রাহ্য করা আর সম্ভব নয়। সরকারের উচিত দ্রুততার সাথে এই অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে এবং আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। যদি তা না করা হয়, তবে বাংলাদেশ অনিবার্যভাবে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।