ডিপসিক: চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার নতুন দিগন্ত?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৫ সালে উভয় দেশ মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর ঘোষণা দেয়, যা ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাস্তবে পরিণত হয় এবং শুরু হয় ‘স্পেস রেস’।
আজ, প্রায় সাত দশক পর, বিশ্বের ভূরাজনৈতিক মঞ্চে নতুন এক প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। আগের স্নায়ুযুদ্ধের মতো এবারও প্রযুক্তিই প্রধান হাতিয়ার, তবে এবারের কেন্দ্রবিন্দু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)।
চীনের ডিপসিক: এআই দৌড়ে নতুন বিপ্লব?
২০২২ সালে ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি চালুর পর থেকে এআই গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল। গুগলের ‘জেমিনাই’, মেটার ‘লামা’, মাইক্রোসফটের ‘কোপাইলট’ এবং অ্যানথ্রপিকের ‘ক্লড’-এর মতো মডেলগুলো বাজারে আসার পর এআই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়।
এদিকে, চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০২৩ সালে মার্কিন সরকার এআই-সংক্রান্ত অত্যাধুনিক চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চীনের স্বল্প পরিচিত স্টার্টআপ ডিপসিক বিশেষায়িত এআই মডেল ‘আর১’ উন্মোচন করে, যা অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপল স্টোরের শীর্ষ রেটিংপ্রাপ্ত অ্যাপ হয়ে ওঠে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিপসিকের ‘আর১’ এবং ‘ভি৩’ মডেলগুলো কার্যক্ষমতার দিক থেকে পশ্চিমা মডেলগুলোর সমতুল্য, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েও রয়েছে। স্কেল এআই-এর সিইও আলেকজান্ডার ওয়াং জানিয়েছেন, ডিপসিকের পারফরম্যান্স শীর্ষ মার্কিন মডেলগুলোর কাছাকাছি।
কম খরচে এআই বিপ্লব
ডিপসিক দাবি করছে, তাদের নতুন মডেল তৈরিতে মাত্র ৫.৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, যেখানে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো একই ধরনের এআই তৈরি করতে ১০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করে। ট্রাম্প প্রশাসনের সাবেক উপদেষ্টা ও প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী মার্ক আন্দ্রেসেন ডিপসিককে “এআই যুগের স্পুটনিক মুহূর্ত” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ডিপসিকের মডেলগুলো ওপেন সোর্স, যা গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত। এতে ব্যবহারের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই এবং এটি বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। ওপেনএআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যানও এটিকে চ্যাটজিপিটির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
বাজারে প্রভাব ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
ডিপসিকের উত্থান বৈশ্বিক শেয়ারবাজারেও বড় প্রভাব ফেলেছে। মার্কিন প্রযুক্তি খাতের শেয়ারগুলোতে দরপতন হয়েছে, বিশেষত চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া ও ব্রডকম উল্লেখযোগ্যভাবে মূল্য হারিয়েছে। এনভিডিয়ার শেয়ার একদিনে ১৭% কমে ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা ওয়াল স্ট্রিটের ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ ক্ষতি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ডিপসিকের উত্থানকে “সতর্ক সংকেত” হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতকে আরও উদ্ভাবনী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এআই প্রতিযোগিতায় চীনের এই অগ্রগতি বিশ্ব প্রযুক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ককে নতুন পথে পরিচালিত করতে পারে।