কলকাতার অনেক বাঙালির মধ্যেই গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ নিয়ে অস্বস্তি এবং হতভম্ব হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে বাবা-কাকার কাছে ঢাকা ও বাংলাদেশের নানা গল্প শোনা এক কলকাতার নারী বলেন, “এখন আর বাংলাদেশে যাব না। সেদেশে তো ইতিহাসই পাল্টে দেওয়া হচ্ছে, তাহলে কী দেখতে যাব?” তার মতো অনেকেই একই মনোভাব প্রকাশ করছেন, বিশেষত আগস্ট মাসের পর থেকে। এটা এমন সময় যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কলকাতার সাধারণ মানুষের মনে একটা অস্বস্তি তৈরি করেছে।
এই এক নারীর মতো কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের মধ্যে বাংলাদেশে যাওয়ার প্রতি অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসা মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে মেডিক্যাল ভিসা ছাড়া ভারতীয় ভিসা পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে, ফলে কলকাতার নিউ মার্কেটের মতো জায়গায় যে বাংলাদেশি পর্যটকরা সাধারণত আসতেন, তাদের উপস্থিতি এখন প্রায় অনুপস্থিত।
কিছুদিন আগেই কলকাতার রাজা গাঙ্গুলি, যিনি দীর্ঘদিন প্রবাসী ছিলেন, ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “অগাস্টে বাংলাদেশে যাওয়ার আগে অনেকেই আমাকে বারণ করেছিলেন, তাদের আশঙ্কা ছিল যে সেখানে আমাকে ভারতীয় হিন্দু হিসেবে আক্রমণ করা হতে পারে। কিন্তু আমি ঠিকই গিয়েছিলাম, এবং বহু মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিলাম, তারা আমাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু দেশে ফিরে এসে আমি যখন তাদের বললাম যে বাংলাদেশে আমার সঙ্গে কী ঘটেছিল, তখন সেটা বিশ্বাস করতে তারা প্রস্তুত ছিল না।”
রাজা গাঙ্গুলির মতে, বাংলাদেশে এখন যে রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা কলকাতার সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই অবাক করা। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মনে করছেন যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের কাছে এক অজানা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে কলকাতার মানুষের মধ্যে এক ধরনের দিশাহীনতা এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে।
এটা শুধু রাজনীতি নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানেও বাধা তৈরি হচ্ছে। কলকাতার ব্যবসায়ী অভিজিত মজুমদার বলেন, “গত বছর জুলাই মাসে আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক জায়গায় ঘুরেছি এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, তবে একদম কোনো আলাদা অনুভূতি ছিল না। তবে আগস্ট মাসের পরে, যে পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয়েছে, তা একদম অপ্রত্যাশিত ছিল।” তিনি জানান যে, ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে যেসব সমস্যার কথা সাধারণ মানুষ বলতেন, সেগুলো নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ ছিল, কিন্তু বাংলাদেশে আসার পরপরই পরিস্থিতি বদলে গেছে।
কলকাতার স্নেহাশিস সুর বলেন, “পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এক সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল। বাংলাদেশের মানুষের কলকাতায় যাতায়াত ছিল এবং কলকাতার মানুষও বাংলাদেশে যেতেন। কিন্তু আগস্ট মাসের পর থেকেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং সন্দেহের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা এই সম্পর্কের মধ্যে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী মনে করেন, কলকাতার সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শকড্। তারা জানতেন না যে বাংলাদেশের মধ্যে এমন এক অস্থির পরিস্থিতি চলমান। বিশেষত, যেহেতু কলকাতার অনেক শিক্ষাবিদ এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, তারা এতদিন বাংলাদেশে কিছুটা ভালোই ভাবছিলেন। কিন্তু এখন, এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে কলকাতার মানুষ খুবই হতভম্ব।
এছাড়া, কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক তপশ্রী গুপ্তও এই পরিবর্তনকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে একসময় যেসব সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল, তা এখন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। আমি অনেক বাংলাদেশি বন্ধুকে জানতাম, যারা এই পরিবর্তনের শিকার হয়েছেন, এবং আমি ভাবতেও পারিনি যে তারা এই অবস্থার মধ্যে পড়ে এভাবে বদলে যাবেন।”
সবশেষে, কলকাতার মানুষ, যদিও হতভম্ব এবং শকড্, তারা আশা করছেন যে দুই দেশের সম্পর্ক আবারও স্বাভাবিক হবে। তারা চান যে দুই বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং মানবিক সম্পর্ক বজায় থাকুক, এবং আবারও বাংলাদেশি সংস্কৃতি কলকাতায়, এমনকি একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।