ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফেডারেল আদালতে ঘুস এবং প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। এর পরপরই, আদানি গ্রুপের ব্যবসায়িক কার্যক্রম নানা দেশে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বন্ড বিক্রির পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়, কেনিয়ায় বিমানবন্দর এবং বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের চুক্তি বাতিল হয় এবং শ্রীলংকায় আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। তবে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে, যেখানে আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত বিতর্কিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাতিল বা সংশোধন করার কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি। বরং বাংলাদেশ সরকার আদানিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছে, যা দেশের বিদ্যুৎ খাতের বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
আদানির সাথে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল। ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং আদানি পাওয়ারের মধ্যে ২০০ কোটি ডলারে গড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির অধীনে, বাংলাদেশ ২৫ বছর ধরে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করবে। তবে এই চুক্তি নিয়ে খাতসংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন অসঙ্গতির অভিযোগ করেন, বিশেষ করে বিদ্যুতের দাম এবং কয়লার মূল্য নিয়ে।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪,৩৮৮ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে আদানি গ্রুপ থেকে। গত বছরের জুন পর্যন্ত, বিপিডিবির কাছে আদানি পাওয়ারের বকেয়া ছিল প্রায় ৬,৩৯০ কোটি টাকা, যা পরবর্তীতে বেড়ে ৭৭ কোটি ডলারে পৌঁছায়। এই বকেয়া পরিশোধ করতে গিয়ে সরকার প্রতি মাসে সাড়ে ৮ কোটি ডলার পরিশোধ করছে, যদিও বিদ্যুৎ ক্রয়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। এসব কারণে, বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আদানির প্রতি বারবার চিঠি পাঠাচ্ছে, কিন্তু চুক্তির পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেয়নি।
যদিও আন্তর্জাতিক পরিসরে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং চাপ বেড়েছে, বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এতে করে দেশের বিদ্যুৎ খাতের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার আদানির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে অস্বীকার করছে। এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে, যেমন বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীলতা, কিংবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে সরকারের নতজানু অবস্থান।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ভারত সফরে গেছেন এবং সেখানে এনার্জি উইক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। তবে এ সফরে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে কোনো আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরকারের কর্মকর্তাদের মতে, একদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও, অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের অসম চুক্তি এবং মূল্যবোধ নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের জন্য আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল বা সংশোধন করার সুযোগ ছিল। বৈশ্বিকভাবে আদানি গ্রুপ এখন এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে, যার মধ্যে সরকারের পক্ষে চুক্তিটি সংশোধন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা একটি সুবর্ণ সুযোগ হতে পারত। সরকারের বর্তমান অবস্থান ও সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও উদ্বিগ্ন।
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এ ধরনের চুক্তি পর্যালোচনা করা এবং দেশের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, দেশের বিদ্যুৎ খাতে চুক্তির প্রেক্ষাপটে সরকারের অস্পষ্ট নীতির কারণে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে, যা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অবিচার হতে পারে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে সরকারের নতজানু অবস্থান বাংলাদেশের জন্য একটি বিপদসংকুল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।