বাংলাদেশে শेख হাসিনার শাসনামলে “আইনাঘর” বা গোপন আটক কেন্দ্রগুলো আলোচনায় আসে। এই ছোট, অস্বাস্থ্যকর কক্ষগুলো ছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের, কর্মীদের এবং সাধারণ নাগরিকদের আটক রাখার জায়গা। এগুলো সাধারণত ৩ ফুট বাই ৪ ফুট আকারের হয়ে থাকে এবং সম্পূর্ণভাবে বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে— সূর্যের আলো থাকে না, এবং সেখানে আটকে থাকা মানুষের জন্য কোনো আশার আলো থাকে না। এই কক্ষগুলো এবং সেখানে ব্যবহার করা নির্যাতনের ভয়াবহ পদ্ধতিগুলো আজও মানুষের মনে দাগ কেটেছে, যদিও অনেক সময় কর্তৃপক্ষ ওইসব চিহ্ন মুছে ফেলেছে বা ধ্বংস করে দিয়েছে।
গোপন এই কেন্দ্রগুলোর সাথে সম্পর্কিত একটি ঘটনাতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা এবং গুম কমিশনের সদস্যরা “আইনাঘর” পরিদর্শন করেন, যা এর আগে একেবারেই গোপন ছিল। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (RAB) এবং ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (DGFI) এর মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অধীনে এই কক্ষগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, আন্দোলনকারী ও সাধারণ নাগরিকদের নির্যাতন করা হত। অনেকেই আইনি অধিকার না পাওয়া অবস্থায় এসব সেলে একসময় মারা যান।
পরিদর্শনকালে, ইউনুস এবং তার সঙ্গীরা দেখতে পান যে, এসব কক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কক্ষে ছোট ছোট জানালা থাকে, তবে প্রচুর বাতাস চলাচল করার সুযোগ থাকে না। কেউ কেউ আবার মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর, বন্দী থাকতেন, যেখানে তাদের কোনও সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। বন্দীদের হাতকড়া পড়ানো এবং চোখ বেঁধে রাখা হত, তারা কেবল মঞ্চস্থ হওয়ার সময়ই টয়লেট বা খাওয়ার সুযোগ পেতেন। কিছু ক্ষেত্রে, কক্ষগুলোতে একমাত্র জীবিত চিহ্ন ছিল পাখা, যা অবিরত চলতে থাকত, যা আরও একতরফাভাবে বন্দীদের অব্যক্ত দুঃখের সাক্ষী হয়ে থাকত।
কিছু বন্দী তাদের হতাশার মধ্যে কক্ষের দেয়ালে নিজেদের বার্তা লিখে রাখতেন— পরিবারকে ভালবাসা, জীবন নিয়ে শঙ্কা এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। সবচেয়ে বেশি দেখা যেত “লা ইলাহা ইল্লা আন্তা, সুবহানাকা ইননি কুনতু মিনাজ-জালিমিন”— অর্থাৎ “তুমি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র, আমি অবশ্যই অন্যায় করেছি”। তবে দুঃখজনকভাবে এসব লেখা অনেক সময় কর্তৃপক্ষ মুছে ফেলত, যা আবার এক ধরনের তথ্য লোপের ইঙ্গিত দেয়।
গুম কমিশন, যা গুম হওয়া ব্যক্তিদের তদন্ত করতে গঠন করা হয়, তারা জানায় যে, “আইনাঘর”-এ যে শারীরিক চিহ্ন এবং বার্তা লেখা ছিল, তা মুছে ফেলা হয়েছে। কিছু নির্যাতনের যন্ত্রপাতি, যেমন বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার চেয়ার, তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এসব ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে— কেন সরকার এসব প্রমাণ মুছে ফেলতে দিল, এবং এসবের পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল?
পরিদর্শন শেষে আরও একাধিক প্রশ্ন উঠে আসে। যদিও সরকারিভাবে এই তছনছের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছিল, তবুও যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে যে এসব আটক কেন্দ্র গোপনে পরিচালিত হত এবং অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকের কাছ থেকে শোনা গেছে যে তারা আত্মসম্মান রক্ষার জন্য দেয়ালে দিন গুনতেন, কিংবা নির্যাতনের আওয়াজ শুনতে পেতেন।
এখনকার সময়ে, কিছু সাবেক বন্দী যেমন মোহাম্মদ নাহিদ ইসলাম, যিনি নিজেও একসময় এসব কেন্দ্রে বন্দী ছিলেন, তারা নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তাদের ভাষায়, যে কক্ষগুলোতে তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল, সেগুলোর সাথে তারা আবার পরিচিত হয়েছেন।
“আইনাঘর” এর ভয়াবহতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সরকারের স্বৈরাচারী কার্যক্রম কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। যদিও অনেক প্রমাণ মুছে ফেলেছে কর্তৃপক্ষ, তবুও যারা বেঁচে আছেন এবং যারা এসব কক্ষের ভেতরে নির্যাতিত হয়েছেন, তারা একদিন তাদের কাহিনি সবার সামনে তুলে ধরবেন। এই কেন্দ্রগুলো অনেক বেশি ভয়াবহ ছিল, তবে এগুলোকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, এবং এর প্রভাব ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে।