জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্র কাঠামোর পুনর্গঠন এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই ধারণার আওতায় তারা দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন করতে চায় এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলছে। এনসিপি’র এই প্রস্তাবনা বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামো এবং সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন আনার পক্ষে। দলের নেতারা মনে করছেন, এই পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।
এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন যে, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। তার মতে, বাংলাদেশের হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের ফলে অর্জিত স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে জনগণের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। তারা সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের আশা করছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন এবং তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণাটি মূলত আন্তর্জাতিক ইতিহাসে ব্যবহৃত একটি শব্দ, যা ফ্রান্স, স্পেন এবং অন্যান্য দেশে রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন করতে ব্যবহার হয়েছে। ফ্রান্সে ১৭৯২ সালে প্রথম রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে দ্বিতীয় রিপাবলিকের রূপ নেয়। এর মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এনসিপি এই উদাহরণকে মাথায় রেখে, বাংলাদেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে রয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, জনগণ অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে রাজতন্ত্র বা বর্তমান শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চায় এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
এনসিপি তাদের ঘোষণাপত্রে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণপরিষদ গঠন করার কথা বলেছে। তাদের মতে, বর্তমান সংবিধান জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি, তাই একটি নতুন এবং জনগণের অধিকারের পক্ষে সংবিধান প্রণয়ন অপরিহার্য। তারা দাবি করছে, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য উপযুক্ত সংবিধান রচনা করা সম্ভব হবে এবং তাতে সকল নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
তবে, বিশেষজ্ঞরা এনসিপি’র এই পরিকল্পনার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সাবেক সচিব ও লেখক এ কে আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেছেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি উল্লেখ করেছেন, যদি দেশে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মতবিরোধ থাকে, তবে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, বিএনপি এবং অন্যান্য দলগুলির অবস্থান এক হতে পারে না, যা এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
তাছাড়া, তুহিন খান, এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব, বলেছেন যে, তারা ফ্রান্সের মত সরাসরি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ঘোষণা করতে না চাইলেও, তাদের ঘোষণাপত্রে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার উপাদান রয়েছে এবং এটি বাস্তবায়নে নানা রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তবে, এটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সরকারের ভূমিকার উপর নির্ভর করবে।
এনসিপি’র ঘোষণার মাধ্যমে দেশে একটি নতুন রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সামনে আসলেও, এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। জনমত এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে।