আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা চলছে। এই প্রেক্ষাপটে ধৈর্যের পরীক্ষায় রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। নির্বাচনের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা জানতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় দলটি। আগামী বুধবার এই বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপির মতে, সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনের সময়সীমা ও প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্নরকম বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তাই বিষয়টি পরিষ্কার করতে দলটি সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস পূর্বে জানিয়েছেন, প্রয়োজন হলে বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে ২০২৬ সালের জুনে অথবা ছোট সংস্কারের মাধ্যমে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে। তবে বিএনপি এই সময়সীমার সঙ্গে একমত নয়। তারা চলতি বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। এই দাবিতে বিএনপির সঙ্গে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
জামায়াতে ইসলামী চায় যথাযথ সংস্কার শেষে গ্রহণযোগ্য সময়ের মধ্যে নির্বাচন, অন্যদিকে জুলাই আন্দোলন ঘিরে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও আরও কয়েকটি দল আগে সংস্কার, পরে স্থানীয় নির্বাচন এবং সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ আগে গণপরিষদ নির্বাচনের কথাও বলছে। আবার সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর ধারণাও সামনে এসেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
এমন এক পটভূমিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “আমরা ১৭ বছর ধরে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। এই দাবি থেকে আমরা সরে আসিনি। ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এখনও বিভিন্ন সূত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন সময়সীমা শোনা যাচ্ছে, যা আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।”
তিনি আরও বলেন, “ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আমরা বিশ্বাস করি তিনি নির্বাচন দিতে চান। কিন্তু তার আশেপাশে থাকা কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে—এই আশঙ্কাও অমূলক নয়।”
আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিলেও তাদের ‘প্রেতাত্মা’ এখনো প্রশাসন, মিডিয়া ও ব্যবসায়িক খাতে সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা আব্বাস।
তিনি বলেন, “নির্বাচন বিষয়ে কার কী অবস্থান তা পরিষ্কারভাবে জানতে আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করব। যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না দেওয়ার ইঙ্গিত মেলে, তাহলে আমরা কর্মসূচি ঠিক করব।”
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. ইউনূস। তখন থেকেই বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই সরকারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে।
বিএনপি জানিয়েছে, নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস দেখা দিলে তারা রাজপথে কর্মসূচি দেবে। তবে তার আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করতে চায় দলটি।
তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ও প্রচারনার মাধ্যমে নির্বাচনের দাবিতে জনমত গড়ে তোলা হবে। ইতিমধ্যে তারা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা ১৬ এপ্রিলের বৈঠকের ওপর নজর রাখছি। সেই বৈঠকের পরই পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করা হবে।”অন্যদিকে, বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্টতা নেই। বড় সংস্কার আর ছোট সংস্কার বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। জাতি ও আন্তর্জাতিক মহল এ ধরনের দ্ব্যর্থপূর্ণ বক্তব্য ভালোভাবে নেবে না।”তিনি আরও বলেন, “আমরা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি অনির্বাচিত সরকার। নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়েই আপনাদের দায়িত্ব শেষ হওয়া উচিত।”সব মিলিয়ে, ১৬ এপ্রিলের বৈঠক হবে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। সেখানেই নির্ধারিত হবে, তারা মাঠে আন্দোলনে যাবে নাকি নির্বাচনী প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেবে।