বাংলাদেশে আর কখনো ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ফিরবে না—এমন প্রত্যয় নিয়ে সামনে এগোনোর কথা জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। শনিবার সকালে জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ছিল কেবল ব্যক্তি পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত, জনগণের অধিকার নিশ্চিতকারী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের লক্ষ্যেই আমরা আন্দোলন করেছি। আমাদের চাওয়া, রাষ্ট্র কাঠামোয় মৌলিক সংস্কার এনে তার গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করা।
তিনি আরও বলেন, সংবিধানে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল, যার কারণে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বেড়ে চলেছে। তাই আমরা সংস্কার বলতে বুঝি এমন পরিবর্তন, যা এই কাঠামোয় আমূল ও গুণগত পরিবর্তন আনবে।
রাষ্ট্র সংস্কারে এনসিপি যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, সেগুলো হলো—সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি। নাহিদ জানান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগের সঙ্গেই এনসিপি একমত, আর যেসব ক্ষেত্রে দ্বিমত বা আংশিক মতবিরোধ আছে, সেখানে সংক্ষিপ্ত সুপারিশ জমা দেওয়া হয়েছে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “নির্বাচনের দিকে এগোতে হলে আগে বিচার ও সংস্কার দৃশ্যমান করতে হবে। নির্বাচন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তার আগে এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন জরুরি।”
আখতার আরও বলেন, “বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ কাঠামোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি সম্ভব নয়। আমরা ক্ষমতার ভারসাম্য এবং সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের পক্ষে কথা বলছি।”
তিনি জানান, এনসিপি বিশ্বাস করে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে, কেবল আইন নয়, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া জরুরি।
সংবাদকর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নামকরণে ‘নির্বাচন’ শব্দটি থাকা উচিত। এই সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে—এটাই মূল বিষয়।”
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা দুটি নির্বাচন চাই না, চাই একটি নির্বাচন, যা সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি গণপরিষদের বৈশিষ্ট্যও বহন করবে। আমাদের প্রথম কাজ হবে সংবিধান পুনর্লিখন।”
তিনি আরও বলেন, “সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের এখতিয়ার গণপরিষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই আমরা চাই একই সঙ্গে সংসদ নির্বাচন এবং গণপরিষদ গঠনের বৈধতা আসুক।”
বিএনপির সঙ্গে কিছু সুপারিশে মতপার্থক্য থাকলেও, আলোচনা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমেই ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন হাসনাত। তিনি বলেন, “এই ঐক্য দলীয় নয়, জাতীয় স্বার্থে গঠিত হবে।”
তিনি জানান, বৈঠকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে—নাগরিক অধিকার, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “একজন ব্যক্তি যেন সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, আমরা এখনো এই অবস্থানেই আছি।”
বৈঠকের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের দায়িত্ব, সবাই মিলে এই ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ করে একটি নতুন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও, আলোচনা চলবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তা অব্যাহত থাকবে।”