Tuesday, April 29, 2025
spot_imgspot_img
Homeআন্তর্জাতিকদক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের আশঙ্কা: ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় বিশ্ব উদ্বিগ্ন

দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের আশঙ্কা: ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় বিশ্ব উদ্বিগ্ন

পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে টানটান উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। পরমাণু শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশীর বৈরী অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনা উস্কে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানালেও পরিস্থিতি দিনদিন আরও সংঘাতমুখী হয়ে উঠছে।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, ভারত আর কেবল প্রতিরক্ষা নয়—এবার পাকিস্তানে প্রত্যাঘাতমূলক সামরিক অভিযানের সক্রিয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিক রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন। প্রকাশ্যে এসব পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও, কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এগুলোর উদ্দেশ্য মূলত সম্ভাব্য অভিযানের যৌক্তিকতা তুলে ধরা।

২৪ এপ্রিল দেওয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করলেও সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর অবস্থান ও শাস্তির হুমকি দেন। ইতিমধ্যে সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। কাশ্মীরে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে এবং শত শত মানুষ গ্রেফতার হয়েছে। ভারত সরকার পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি নিয়ন্ত্রণ এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ জারি করে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান কাশ্মীর সীমান্তে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্থগিত করেছে এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের ঘোষণা দিয়েছে। অতীতেও এ ধরনের উত্তেজনা দেখা গেছে, তবে এবারের পরিস্থিতি অনেক বেশি নাজুক, বিশেষ করে দুই দেশের নেতৃত্বের কণ্ঠে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়তা ও হুমকি স্পষ্ট।

এই সময়ে ভারতে মুসলিমবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শহরে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। যদিও ভারত সরকার এখনও কোনও নির্দিষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম ঘোষণা করেনি বা পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার নির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেনি, কর্মকর্তারা অতীতের ঘটনার ভিত্তিতে পাকিস্তানকে দায়ী করছেন এবং কিছু প্রযুক্তিগত প্রমাণের কথা বলছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত হয়ত এখনো তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে, কিংবা আন্তর্জাতিক সমীকরণকে আমলে না নিয়েই পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ায় আন্তর্জাতিক চাপ অনেকটাই উপেক্ষাযোগ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বর্তমানে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকট নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার দিকে নজর অনেকটাই কমে গেছে।

ইরান, সৌদি আরব এবং জাতিসংঘ সংযমের আহ্বান জানালেও কার্যকর মধ্যস্থতা এখনো দৃশ্যমান নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপে সমর্থন দিলেও কার্যত দক্ষিণ এশিয়া এখন তাদের কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারতে এখনো একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়নি, যা মার্কিন প্রশাসনের এই অঞ্চলের প্রতি সীমিত মনোযোগের ইঙ্গিত দেয়।

২০১৯ সালে জইশ-ই-মুহাম্মদের নাম সামনে এলেও এবার হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি গোষ্ঠী, যাকে ভারত লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন হিসেবে সন্দেহ করছে। হামলাকারীদের পরিচয় ও সংখ্যা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। পরে টিআরএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের নামে সাইবার হামলার মাধ্যমে দায় স্বীকারের পোস্ট ছড়ানো হয়েছে।

ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেননের মতে, মোদি সরকারের সামনে সামরিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া কার্যকর কোনো পথ খোলা নেই। ২০১৬ ও ২০১৯ সালের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। এবারও সরকার জনমত ও রাজনৈতিক চাপের মুখে আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে পারে।

মোদি সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে “পূর্ণ স্বাধীনতা” দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যার অর্থ প্রতিরক্ষাবাহিনী এখন তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাল্টা হামলা চালাতে পারবে। পাকিস্তানও পাল্টা প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং দেশটির রেলমন্ত্রী হানিফ আব্বাসী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন—পাকিস্তানের ১৩০টি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত রয়েছে, বিশেষ করে সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ হলে তা যুদ্ধের ইঙ্গিত হতে পারে।

কাশ্মীরকে ঘিরে অতীতের তিনটি যুদ্ধ প্রমাণ করে যে এই সংকট কখনোই সীমিত পর্যায়ে থাকে না। ভারত বরাবরই বিষয়টিকে দ্বিপাক্ষিক বলে মনে করে, ফলে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। কৌশলগত অবস্থানে ভারত তুলনামূলক সুবিধাজনক, কারণ দেশটির মিত্রের তালিকায় রয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্প্রতি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বেড়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান ঐতিহ্যগতভাবে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সীমিত মার্কিন সমর্থন পেয়ে থাকে।

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) পাকিস্তানের জন্য একটি বড় কৌশলগত ভরসা হলেও ভারত কোয়াড জোটের (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে এগিয়ে আছে।

সবশেষে, এই দুই দেশের সামরিক উত্তেজনা এবং হুমকি পাল্টা হুমকির রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়াকে বড় ধরনের সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। যে কোনো সময় একটি ভুল সিদ্ধান্ত বা ভুল ব্যাখ্যা যুদ্ধের বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে। এখন প্রয়োজন দ্রুত ও বাস্তবভিত্তিক কূটনৈতিক সংলাপ, যাতে এই অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন অনিশ্চয়তার মুখে না পড়ে। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় তা কতটা সম্ভব—সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments