ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা আবারও তীব্র আকার ধারণ করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ মুহূর্তের পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাবিদ ও বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কির একটি সতর্কবার্তা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডন এ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চমস্কি তার বই Nuclear War and Environmental Catastrophe-এ বলেছিলেন, “মানবজাতির টিকে থাকার জন্য দুটি প্রধান হুমকি রয়েছে—একটি পারমাণবিক যুদ্ধ, অপরটি পরিবেশগত বিপর্যয়।” যদিও পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা অনেকের কাছে দৃশ্যমান, পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা এখনো অনেকের কাছে অবজ্ঞার বিষয় রয়ে গেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলে পরিবেশ সংকট এখন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
আঞ্চলিক নদীগুলো হিমবাহ গলা, শহরায়নের চাপ, বড় বাঁধ নির্মাণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংকটে পড়েছে। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই খরা ও বন্যার প্রবণতায় ভুগছে। এ অবস্থায় পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধ নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। কাশ্মীর অঞ্চলে বারবার ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে, এবছরও সেই শঙ্কা রয়ে গেছে।
সম্প্রতি কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ঘৃণা ও প্রতিশোধের রাজনীতি আরও চাঙ্গা হচ্ছে। অথচ এই সংকটময় সময়ে পারস্পরিক দোষারোপ নয়, পরিবেশগত সংকট মোকাবিলার জন্য যৌথ প্রয়াস ও সংলাপের প্রয়োজন।
চমস্কি এ প্রসঙ্গে বলেন, “পারমাণবিক যুদ্ধ চালাতে সচেতন প্রচেষ্টা লাগে, কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলার মাধ্যমে।” তিনি আরও সতর্ক করেন—বন উজাড়, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ও কৃষিজমি ধ্বংস করে বায়োফুয়েল উৎপাদন—এসবই পরিবেশ ধ্বংসের বড় কারণ।
ভারত ও পাকিস্তান এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানি পরিবেশবিদ আইশা খান মন্তব্য করেছেন, “হিমবাহ সংকটই যথেষ্ট ভয়ের, তার সঙ্গে যদি পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের হুমকি যোগ হয়, তাহলে তা আরও মারাত্মক।” তিনি ভারতের ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ স্থগিত রাখার প্রস্তাবের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন, যা পাকিস্তানের জন্য পানি নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যদিও ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিটি বাতিল করেনি, তবুও পাকিস্তান এটিকে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য হিসেবে দেখছে। বাস্তবে এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে সময়, অর্থ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রয়োজন, যা তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়। তবে আলোচনার দরজা খোলা থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় আশাবাদের জায়গা।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে।
আরেকটি ভয়াবহ বাস্তবতা হলো—ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। ইউক্রেন-রাশিয়া বা ইসরায়েল-গাজার মতো এখানেও ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। ভারতীয় মিডিয়ায় মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চলছে, যার প্রতিবাদ উঠেছে কাশ্মীরের বিধানসভা থেকেও। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ধর্মীয় বাণীর আড়ালে প্রতিশোধের বার্তা দিচ্ছেন। অপরদিকে, পাকিস্তানেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে।
তবে ইতিহাস বলে, হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান অসম্ভব নয়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার প্রদানের পক্ষে ছিলেন।
সবশেষে বলা যায়, পারমাণবিক সংঘাত নয়, পরিবেশ সংকটই এখন ভারত-পাকিস্তান অঞ্চলের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং মারাত্মক হুমকি। এই বিপদ মোকাবিলায় প্রয়োজন পারস্পরিক বোঝাপড়া, আন্তরিক সংলাপ এবং কার্যকর পরিবেশ সংরক্ষণ নীতি।