মানবতার এক বীর নারী শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরী। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তিনি রক্ষা করেছেন স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন। মাতৃস্নেহ আর শিক্ষকসুলভ দায়িত্ববোধে তিনি রেখে গেছেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ঢাকার উত্তরা এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের সেই ভয়াবহ দিনে, যখন সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুটছিল, তখন মাহেরিন চৌধুরী নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের আগুন ও ধোঁয়ার ভেতর থেকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় কমপক্ষে ২০ শিশুর প্রাণ রক্ষা পেলেও, নিজে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ আত্মত্যাগ শিক্ষকতা পেশার এক উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে থাকবে।
স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, তার সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরা তাকে স্মরণ করছেন গভীর শ্রদ্ধায়। সবার বক্তব্যে উঠে এসেছে—তিনি একজন দায়িত্বশীল, নিবেদিতপ্রাণ ও ভালোবাসায় পূর্ণ মানুষ ছিলেন।
মাহেরিন চৌধুরী স্কুলের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কো-অর্ডিনেটর ছিলেন এবং সেখানে দীর্ঘ ১৭ বছর শিক্ষকতা করেছেন। সহকর্মীরা জানান, তিনি শুধু একজন শিক্ষিকা নন, ছিলেন মা-সম এক অভিভাবক। স্কুলের প্রধান খাদিজা আক্তার বলেন, মাহেরিন ছিলেন এক মানবিক ও পেশাদার শিক্ষক, যিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন শিক্ষকের প্রকৃত পরিচয় কী।
ঘটনার সময়কার বিবরণ দিতে গিয়ে শিক্ষক শেখ ফরিদ জানান, ছুটির পর মাহেরিন শিশুদের ক্লাস থেকে বের করে অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করছিলেন। দুর্ঘটনার মুহূর্তে তিনি নিজে না পালিয়ে বরং আটকে পড়া শিশুদের উদ্ধারে ফিরে যান। এ সময় তার শরীরে আগুন ধরে যায়। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও রাতে মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।
রাত ১০টার দিকে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মাহেরিন চৌধুরী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
তিনি রাজধানীর উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ছিলেন এবং তার প্রথম জানাজা সেখানেই অনুষ্ঠিত হয়।
স্কুল প্রাঙ্গণে ভিড় করে আসা শিক্ষার্থীরা কাঁদতে কাঁদতে বলেন—তিনি ছিলেন খুবই স্নেহময়ী ও দায়িত্ববান শিক্ষিকা।
মাহেরিন চৌধুরী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। তার বাবা মহিতুর রহমান চৌধুরী ও মা সাবেরা চৌধুরী। তার ভাই মুনাফ মুজিব চৌধুরী জানিয়েছেন, মাহেরিন ছিলেন তাদের পরিবারের বড় মেয়ে এবং মায়ের অভাব পূরণ করেছিলেন।
স্বামী মনসুর হেলাল জানান, ১০০ ভাগ না হলেও প্রায় সম্পূর্ণ দগ্ধ হয়েছিলেন মাহেরিন। মৃত্যুর আগেও তিনি জানিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি বাচ্চাদের উদ্ধার করতে ফিরে গিয়েছিলেন।
উদ্ধারকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে একে একে প্রায় ২০ শিশুকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
সাংবাদিক ফজল এম কামাল বলেন, মাহেরিন শিক্ষকতার যে মহৎ আদর্শ রেখে গেছেন, তা যুগের পর যুগ মানুষ স্মরণে রাখবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কেউ তাকে ‘প্রকৃত মা’ বলেছেন, কেউ বলছেন ‘শিক্ষিকার প্রতিচ্ছবি।’
আরেক শিক্ষক মাসুকা বেগমও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এবং আরও ছয়জন শিক্ষক চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
মাহেরিন চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ী গ্রামে। মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। এলাকাবাসীর মতে, তিনি একজন শিক্ষানুরাগী ছিলেন এবং গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রেখেছেন।
তার স্বামী জানান, দুর্ঘটনার সময় শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে ভেতরে প্রবেশ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মাহেরিন। বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়ার আগেও স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা বলেন তিনি। মৃত্যুকালে রেখে গেছেন দুই পুত্র সন্তান।