আন্দোলন, রক্ত আর প্রতিরোধের গল্পের মাঝেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে যে সম্পর্ক, তার নাম– বন্ধুত্ব। আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবসের ঠিক আগের দিনে ফিরে দেখা যাক সেই সব বন্ধুত্বকে, যেগুলো গড়ে উঠেছে রাজপথের লড়াইয়ে।
প্রতি বছর যখন আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস আসে, তখন আমরা বলি– ‘বন্ধুরাই আমাদের জীবনকে রঙিন করে’, ‘বন্ধু মানেই নির্ভরতা’। কিন্তু কখনও কি ভেবেছি, এই বন্ধুত্ব যদি জন্ম নেয় চোখের জল, রক্ত, আর দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে– তখন তার রূপ কেমন হয়? তখন বন্ধুত্ব আর নিছক আবেগ নয়; তখন তা হয়ে ওঠে সাহস, প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়া এক রাজনৈতিক চেতনা।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবি কিংবা ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণআন্দোলন— এসব কেবল রাজনৈতিক অধ্যায় নয়; এগুলো একেকটা বন্ধুত্বের পরীক্ষার মুহূর্ত। তখন বন্ধু মানে– কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নামা, আহত বন্ধুকে সরিয়ে নিতে গিয়ে নিজের শরীরে গুলি নেওয়া, তপ্ত রাস্তায় পানি নিয়ে ছুটে আসা। আর যখন সেই বন্ধু শহীদ হয়, তখন তার স্মৃতিকে ধরে রাখে তারই বন্ধুদের আঁকা গ্রাফিতি, লেখা স্লোগান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই অনেকেই শুনে থাকেন, ‘এখানে সত্যিকারের বন্ধু হয় না।’ হয়তো এটা এক প্রজন্মের অভিজ্ঞতা– যেখানে সন্দেহ মিশে থাকে, যে মানুষটা পাশে আছে সে সত্যিই বন্ধু, নাকি সুবিধাবাদী কেউ?
কিন্তু ঈশপের গল্পের মতো, ভালুক এলে কে পাশে দাঁড়ায় আর কে পালিয়ে যায়– সেটিই ঠিক করে প্রকৃত বন্ধু কে। আর আজকের আন্দোলনে সেই ‘ভালুক’ এসেছে রাষ্ট্রীয় হিংসার রূপে।
আন্দোলনে অনেকেই শুধু বন্ধু হননি, বরং বন্ধুর জন্য নিজের জীবনও বাজি রেখেছেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রবিন বলেন, “কোটা সংস্কারের দাবিতে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন ভেবেছিলাম, সরকার দ্রুত দাবি মেনে নেবে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি, দমন আর প্রাণহানির পর আর বসে থাকা যায়নি। আমরাও রাস্তায় নেমেছিলাম। আন্দোলনে আমি গুলিবিদ্ধ হই, আমার এক বন্ধু রাবার বুলেটে চোখ হারায়। হাসপাতালে নিতে নিতে তার রক্তে আমার শার্ট ভিজে যায়। তখন তাকে বলেছিলাম: তোর এই ত্যাগ বৃথা যাবে না।”
নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সম্পন্ন মহাপাত্র বলেন, “আন্দোলনের সাহস জুগিয়েছে আমার বন্ধুরাই। যারা বহুদিনের পরিচিত, আবার অনেক নতুন বন্ধুও পেয়েছি রাজপথে। আহতদের চিৎকার আমাদের সংগ্রামের আগুনে পরিণত হয়েছে।”
তখন বন্ধুত্ব মানে আর চা খাওয়া, গল্প করা, সিনেমা দেখা নয়। তখন বন্ধুত্ব মানে প্রতিবাদে গলা মেলানো, রাস্তায় গুলি চলার সময় বুক পেতে দাঁড়ানো।
জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী জামিল হোসেন সিয়াম বলেন, “আন্দোলনে এই বন্ধুত্বই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এখানে পুরনো পরিচয় ছাড়িয়ে গড়ে উঠেছে নতুন আস্থা। অনেক নতুন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে, যারা রাজপথে আমাদের সঙ্গে ছিল একই দাবিতে। মনোবল হারানোর সুযোগই ছিল না।”
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েক সপ্তাহ পর আসে নির্দেশ: ‘সবাইকে হল ছাড়তে হবে।’ সেটা ছিল আতঙ্কের বিদায়। তখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছে: “আবার দেখা হবে তো?” অনেকের সঙ্গে আর দেখা হয়নি– কেউ আহত, কেউ নিখোঁজ, কেউ কারাবন্দি।
কিন্তু ঠিক তখনই বোঝা যায়, বন্ধুত্বের সত্য রূপ। যে বন্ধু মাসে একবারও ফোন করত না, সেও খোঁজ নেয়: “ভাল আছিস তো?” এই একটি প্রশ্নই মুছে দেয় বহুদিনের দুরত্ব।
আন্দোলনে কারও গুলি লাগার খবর ছড়ালে, ১০ জন দৌড়ে যায় হাসপাতালে। কেউ গ্রেপ্তার হলে, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তার মুক্তির দাবি উঠে। যে ছেলেটা কোনোদিন স্লোগান দেয়নি, সেও গলা ফাটিয়ে বলে, “আমার ভাইয়ের মুক্তি চাই!”
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও পাশে থেকেছে। বিএএফ শাহীন কলেজের বন্ধুরা শহীদ আহনাফের আসনে পরীক্ষার দিন ফুল রেখে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বন্ধু ওয়াকিফ লিখেছে, “১৫ তারিখ ফারহান বলেছিল, ‘প্রাউড অব ইউ’। ১৮ তারিখে সে আমাদের গর্ব হয়ে শহীদ হলো। তার রক্ত বন্ধুত্বের স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে।”
এক সময় বন্ধুত্ব মানে ছিল– গল্প, আড্ডা, সিনেমা। এখন তা মানে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদের গান, রক্তমাখা শার্ট, শপথের স্লোগান। কেউ আর বলতে পারবে না, এই প্রজন্মের বন্ধুত্ব কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’-এ আটকে আছে। বরং এ সম্পর্ক এমন, যা চোখের আড়ালেও চেতনাকে আলো করে রাখে।
যখন কেউ বলবে, “এখন আর তেমন বন্ধুত্ব হয় না”, তখন ইতিহাসে লেখা থাকবে– বন্ধুত্ব হয়, এমন বন্ধুও হয় যে গুলি দেখে পালায় না, বরং দাঁড়িয়ে বলে,