আবারও এসেছে আগস্ট। সময়ের চক্র ঘুরে ফিরে এসেছে সেই মাস, যার স্মৃতি এখন স্বপ্নের মতোই ধরা দেয়। মনে পড়ে শহীদ মিনার, সেই জনসমুদ্র, যেদিন সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে নিপীড়ন-নির্যাতনের করাল ছায়া, অন্যদিকে সেই মানুষগুলোই হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের অদম্য প্রতীক। সেই রূপে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কারের মুহূর্ত ছিল তা।
২০২৪ সালের জুলাই যেন বাংলাদেশ এবং তার জনগণের জন্য এক নতুন জন্মের ইতিহাস। নজরুলের ‘ফরিয়াদ’ কবিতা যেন মূর্ত হয়ে দেখা দিয়েছিল সেদিন পথে নামা মানুষের মাঝে। দেশটা যেন এক বিশাল কারাগারে রূপ নিয়েছিল, আর তার মুক্তির চাবিকাঠি ছিল সাধারণ মানুষের হাতে—নারী, পুরুষ, শিশু সবাই মিলে গড়ে তুলেছিল ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নিজেদের।
এই ঐক্যবদ্ধ চেতনা থেকেই এসেছে মুক্তি। একবার যে জাতি নিজ শক্তিকে চিনে ফেলে, তাকে আর কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না। কবির ভাষায়—
“কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান?
আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ—
এতদিনে ভগবান!”
২০২৫ সালের ৩ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দুটি পৃথক সমাবেশ—একটি ছাত্রদলের শাহবাগে, অন্যটি এনসিপির শহীদ মিনারে। অথচ এক বছর আগে একই দিনে লাখো সাধারণ মানুষ একত্র হয়েছিল একটি সমাবেশে, যেখানে রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়ে মানুষ হিসেবে নিজেদের মর্যাদার জন্য রাস্তায় নেমেছিল। আর দু’দিন পরেই এসেছিল সেই কাঙ্ক্ষিত জয়।
আজ সেই ঐক্য আলাদা আলাদা রাজনৈতিক ব্যানারে ভাগ হয়ে গেছে। কেউ পদযাত্রা করছে, কেউ সমাবেশ করছে—কারও মধ্যে মিল, কারও মধ্যে মতপার্থক্য। যদিও মুখোমুখি আলোচনায় বিরোধ স্পষ্ট নয়, তবে অনলাইনের পর্দায় চলছে তীব্র ছায়াযুদ্ধ, কোথাও কোথাও শালীনতার সীমাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে—জুলাইয়ের আন্দোলনে কার অবদান কতখানি!
তবে এই আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন সেই হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে, যারা ঢাকার বছিলা থেকে, যাত্রাবাড়ি থেকে, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট থেকে ঝড়-বৃষ্টি, পুলিশের বুলেট, জলকামান উপেক্ষা করে পথে নেমেছিল। আজ তাদের কথা কে বলছে? নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে তাদের জায়গা কোথায়?
নির্বাচন আসন্ন। কবি সুমনের ভাষায়, এখন অবস্থা এমন—
“ভোট মানুষের মুখে ব্যালট পেপার, দেখছেন, নেতা দেখছেন!”
কিন্তু এই দেশের মানুষ কী চান, সেটা কি কেবল ব্যালটে সিল মেরে বোঝা সম্ভব? রাজনীতির কক্ষে মাসের পর মাস ধরে যে সভা-পরিকল্পনা হয়, তা কি সত্যিই জনগণের মনোবাসনা প্রতিফলন করে?
জুলাইয়ের সেই উত্তাল জনতার ঢল কেবল পেটের দায়ে রাস্তায় নামেনি। মানুষ হিসেবে নিজেদের অধিকারের জন্য, নাগরিক মর্যাদা রক্ষায় তারা রাস্তায় নেমেছিল। এ দেশের মায়েরা নিজের সন্তানদের রক্ষা করতে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজপথে দাঁড়িয়েছেন। নারীরা নিজেদের সম্মান আদায়ে পথে নেমেছেন সাহসে।
তবে কি এই অন্তর্বর্তী সরকারের একটু সময় হবে তাদের কাছে যাওয়ার? শুধু ঢাকার শাহবাগ আর রমনা দিয়েই বাংলাদেশকে বুঝে ফেলা যায় না। এই শহরগুলোর বাইরেও একটা বিশাল বাংলাদেশ রয়েছে। যদি শুধু রাজধানী থেকেই সব বোঝা যেত, তবে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’র প্রয়োজন হতো না।
এবার, এক বছর পেরিয়ে এসে হলেও, সময় এসেছে ঢাকার বাইরের মানুষের কথা শোনার। ট্রেনে করে লোক এনে বড় বক্তৃতা দিলে পুরো দেশের চিত্র বোঝা যায় না।
এই দেশের মানুষ অপেক্ষা করতে জানে। তারা এখনো আশায় থাকে—একদিন কেউ তাদের কথাও শুনবে। ভাবে, সরকার ও রাজনীতিকরা হয়তো একদিন তাদের গুরুত্ব বুঝবে।
পেছনের ১৫ বছর আমরা দেখেছি—একজন নেতা নিজেই জানতেন কীভাবে সবাইকে ‘উন্নয়ন’ দিতে হয়, আর সেই বিশ্বাসেই মসনদের নিচ থেকে ভিতে ফাটল ধরেছিল। এবার যারা ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছেন, তারা যেন না ভাবেন—চাইলেই আরেক ১৫ বছর নির্বিঘ্নে পার করা যাবে। ২০২৪ সালের সেই স্মৃতি এখনও মানুষের মনে তাজা।
তবে এই জুলাই শুধু বিজয়ের গল্প নয়। এটা সেই দিনগুলোরও স্মৃতি, যেখানে হাজারো মা হারিয়েছেন সন্তান, কেউ হারিয়েছে দৃষ্টি, কেউ অঙ্গ। তাই এই ঘটনা যেন আর না ঘটে—এই দায় রাজনীতিকদের, এই দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের।
এই ২৪ জুলাই যেন হয় একটি অধ্যায়ের শেষ—যেখানে সাধারণ মানুষের ভুলে যাওয়া আর পুনরাবৃত্তি হবে না। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক সেইসব সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বে, যারা বছরের পর বছর কেবল অপেক্ষা করে গেছে।
মানজুর-আল-মতিন
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
এই দেশের তথাকথিত অসংগঠিত সাধারণ মানুষের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিশাল রাজনৈতিক শক্তি। প্রশ্ন হচ্ছে—ভোটের ট্রেনে উঠে পড়ার আগে নেতাদের হাতে সময় থাকবে তো তাদের দিকে একবার তাকানোর?