২০২৫ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে এক নাটকীয় মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। দেশজুড়ে চলমান ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা এবং দলীয় কোন্দলে দিশেহারা হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্ত জানানোর পরপরই তিনি যোগাযোগ করেন ভারতের সঙ্গে—এবং ঠিক তখনই পর্দার অন্তরালে শুরু হয় কূটনৈতিক টানাপোড়েন ও আশ্রয় সংক্রান্ত জরুরি প্রস্তুতি।
দুপুর ১২টার কিছু পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি ফোন কল আসে। কলটি করা হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর পরবর্তীতে দেশটির সংসদে দাঁড়িয়ে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনলেও, ফোনটি সরাসরি শেখ হাসিনা নিজে করেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও জয়শংকর কোনো নাম প্রকাশ করেননি, কূটনৈতিক নিয়ম অনুযায়ী এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যেই সাধারণত যোগাযোগ হয়।
ফোনালাপে শেখ হাসিনা ভারতের কাছে একটি নিরপদ প্রস্থানপথ ও সাময়িকভাবে ভারতে অবস্থানের অনুমতি চান। তাঁর অনুরোধে দিল্লি দ্রুত সাড়া দেয় এবং তাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, “যখনই প্রয়োজন, আপনি আসতে পারেন। আমাদের আকাশসীমা ও মাটি আপনার জন্য উন্মুক্ত।”
প্রথম ফোনালাপের কিছুক্ষণ পরেই আসে দ্বিতীয় ফোন—এবার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতের বিমানবাহিনীতে। ফোনের উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট: শেখ হাসিনাকে বহনকারী সামরিক বিমান যাতে ভারতের নির্ধারিত ঘাঁটিতে নিরাপদে অবতরণ করতে পারে, সে জন্য আনুষ্ঠানিক অনুমতি বা ‘ক্লিয়ারেন্স’ চাওয়া হয়।
ভারতীয় বিমানবাহিনী তাত্ক্ষণিকভাবে সে অনুমতি দেয় এবং সম্ভাব্য বিমানঘাঁটি প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা পাঠানো হয়। এই ধরনের ক্লিয়ারেন্স সাধারণত উচ্চ নিরাপত্তা পর্যায়ের এবং রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর পরিস্থিতির জন্যই সংরক্ষিত থাকে।
এই দ্বিতীয় ফোন কলের পেছনে একটি গভীর রাজনৈতিক ও কৌশলগত বাস্তবতা রয়েছে। শেখ হাসিনা জানতেন, দেশজুড়ে চলমান বিক্ষোভ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে বিশ্বাসভঙ্গের এই মুহূর্তে তাঁর প্রাণনাশের ঝুঁকি প্রবল। ফলে প্রস্থানকে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দিক থেকেও দেখতে হচ্ছিল।
বলা হয়ে থাকে, ১৯৭৫ সালে তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যেভাবে জীবন বাঁচিয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এই পরিস্থিতিটিও অনেকটা সেই ঘটনার প্রতিধ্বনি বহন করে। তবে এবার প্রেক্ষাপট আলাদা। এবার তিনি নিজেই রাষ্ট্রীয়ভাবে শাসক ছিলেন, এবং তার নিজের সরকারের অধীনে থেকেই তাকে দেশত্যাগের প্রক্রিয়া শুরু করতে হলো।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করেছে। তবে আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার গণজাগরণ, নিরাপত্তা বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজর দিল্লিকে একপ্রকার কৌশলী ভূমিকা নিতে বাধ্য করে। শেখ হাসিনার অনুরোধে তারা সম্মানজনক প্রস্থান নিশ্চিত করে—তবে সেইসঙ্গে একটি ইঙ্গিতও দেয় যে, তারা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিতে প্রস্তুত।
শেখ হাসিনার দিল্লিতে ফোন করার এই ঘটনা একদিকে যেমন তাঁর পতনের আগের মুহূর্তের সংকট প্রতিফলিত করে, অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হওয়ার ইঙ্গিতও দেয়। ভারত প্রমাণ করেছে, তারা প্রয়োজনমতো রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে প্রস্তুত—কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় তারা এখন আরও কৌশলী।