চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া ও আলোচনা। ঘোষণাপত্রে গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি থাকলেও অনেকেই বলছেন, এতে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এর প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
ঘোষণাপত্রে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র’ গঠনের প্রতিশ্রুতি থাকলেও সাম্প্রতিক বাস্তবতা এবং বর্জিত বিষয়ের তালিকা তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মত বিশ্লেষকদের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলের সমালোচনা থাকলেও তার পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সময়কাল সম্পর্কে কিছু না বলায় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার গঠনের পথ খুলে দিয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্র।”
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, “জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ঘোষণাপত্র ব্যর্থ হয়েছে। এটি ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “১৯৪৭ সালের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম, পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরের ঘটনা, আবরার হত্যাকাণ্ড ও সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনগুলোর উল্লেখ না থাকা দুঃখজনক।”
চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি রেজাউল করীম ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, “ঘোষণার আগে আমাদের মতামত নেওয়া হয়নি, বরং আমাদের উপস্থিত রেখে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা হয়েছে। এতে ফ্যাসিবাদের সহযোগীদেরও উপেক্ষা করা হয়েছে।”
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, “ঘোষণাপত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট উপেক্ষিত। এটি ইতিহাস বিকৃতি এবং আমাদের লড়াই-সংগ্রামের অস্বীকৃতি।”
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, “ঘোষণাপত্রের ভাষা আরও প্রাণবন্ত ও আবেগঘন হওয়া উচিত ছিল। এতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যথাযথ উল্লেখ নেই।”
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের মতে, “সংবিধানের তপশিলে এই ঘোষণাপত্র যুক্ত হলেও এর কার্যকর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সংসদে তা নিয়ে আপত্তি ও সংশোধনের সুযোগ থাকবে।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, “জুলাই ২০২৪-কে যদি দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে ধরা হয়, তাহলে ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা জরুরি। সব রাজনৈতিক দলকে এর চেতনায় ঐকমত্যে পৌঁছে দেশ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে।”
সার্বিকভাবে, রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে এলেও, সেটি পূর্ণতা পায়নি। এতে অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি থাকলেও, তা বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক রূপ নিয়েছে।