জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের আগে সেটির চূড়ান্ত কপি মাত্র তিনটি রাজনৈতিক দলকে সরবরাহ করা হয়। যদিও অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছিল ৫০টিরও বেশি দল ও সংগঠনের, বেশিরভাগ দলই ওই আচরণে অসন্তুষ্ট। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ কয়েকটি বাম দল ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠান বর্জন করে, যাদের অভিযোগ—এটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন বহুদলীয় বা দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিএনপি এখন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। তবে পরবর্তী কোনো দলই বিএনপির আশেপাশেও নেই, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবস্থানেও নয়। অন্তর্বর্তী সরকার জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-কে বিকল্প শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত।
ঘোষণাপত্র অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এনে সমাগম ঘটাতে ট্রেন ভাড়ার ব্যবস্থাও করা হয়, যা সরকারের পক্ষ থেকে লোকসমাগম নিশ্চিতের প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং অভিযোগ
গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান বলেন, মাত্র তিনটি দল—বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিকে ঘোষণাপত্রের কপি সরবরাহ করা হয়েছে, অথচ অন্যদের খসড়াও দেওয়া হয়নি। এমনকি যে ঘোষণাটি পাঠ করা হলো, সেটি আগাম জানানো হয়নি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান গাজী বলেন, ৫ আগস্টের প্রতি সম্মান জানিয়ে তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তাঁদের মতামত বিবেচনায় না এনে তিনটি দলের মধ্যে কেবল তথ্য ভাগ করে নেওয়াকে পক্ষপাতদুষ্ট ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), ও জাসদ (আম্বিয়া) অনুষ্ঠানটি বর্জন করে। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অনুষ্ঠানে গিয়ে “সাক্ষী গোপাল” হতে চাননি বলেই তারা অনুপস্থিত ছিলেন। সরকারের আমন্ত্রণে উপস্থিত হলে সেটিকে সম্মতির বার্তা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাঁর ভাষ্য, যারা জুলাই আন্দোলনের অংশ ছিলেন, তাঁদের মতামতকে উপেক্ষা করেই ঘোষণা তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার কিছু নির্দিষ্ট দল ও গোষ্ঠীর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে, এবং এতে বিভক্তির বীজ বোনা হচ্ছে।
বিএনপি ও এনসিপির প্রতিক্রিয়া
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, কার কোন দলকে আগে খসড়া পাঠাবে তা সরকারের বিষয়। যদিও সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। তিনি বলেন, “আমরাও তো সব বিষয়ের সঙ্গে একমত নই, তবুও মেনে নিয়েছি।”
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, কেবল তিনটি দলের মতামত নেওয়া যথেষ্ট নয়। জুলাই আন্দোলনের সব পক্ষের মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে তিনি সরকারের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বহুদলীয় গণতন্ত্র, না একদলীয় নিয়ন্ত্রণ?
বর্তমানে দেশে ৫৫টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থাকলেও, আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। এনসিপিসহ কয়েকটি দল নতুনভাবে নিবন্ধনের চেষ্টা করছে। অনেক দলের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার বৈঠক বা পরামর্শে কেবল কিছু নির্দিষ্ট দলকেই আমন্ত্রণ জানায়।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকার একদিকে এনসিপিকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে অঘোষিত সমন্বয় করছে। আর বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাপ প্রয়োগ করছে। এটি গণতন্ত্র নয়।
ভোট পরিসংখ্যান ও সাম্প্রতিক জরিপ
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলিয়ে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। তখন জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যথাক্রমে ৪.৭% ও ৭.০৪% ভোট পায়। তবে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পতনের পর নতুন সমীকরণ দেখা দিয়েছে।
সানেম-এর এক জরিপে তরুণদের মধ্যে করা মতামত অনুযায়ী, বিএনপি পেতে পারে ৩৮.৭৬% ভোট, জামায়াত ২১.৪৫%, এবং এনসিপি ১৫.৮৪%। যদিও বাস্তব ভোটের হিসাব এবং গণভিত্তি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
বিএনপি নেতা প্রিন্স বলেন, জনগণের অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হবে। কিছু দলকে তুলে ধরে কৃত্রিম দ্বিদলীয়তা তৈরি করলে তা জনগণ মেনে নেবে না।
এনসিপি নেত্রী মনিরা শারমিনও একক আধিপত্যের বিপক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।
বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম মনে করেন, আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে না থাকলেও তাদের ভোটারদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। নির্বাচন দুই ধারায় বিভক্ত হতে পারে—একদিকে থাকবে বিএনপির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধপন্থী লিবারেল শক্তি, অন্যদিকে জামায়াত-এনসিপি নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল ধর্মীয় ঘরানার জোট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, মানুষ এখনো নির্বাচন মানে বোঝে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেও, মানুষের চিন্তায় তারা রয়ে গেছে। বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অন্য কোনো শক্তি এখনো দৃশ্যমান নয়। এনসিপির সম্ভাবনাও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও সরকার-ঘনিষ্ঠতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। মানুষ ‘কিংস পার্টি’ পছন্দ করে না।
সারসংক্ষেপ:
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূল বিরোধীদল বিএনপির মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো শক্তিশালী বিকল্প দল নেই বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সরকার যদি এনসিপি বা জামায়াতকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরতে চায়, সেটি সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলেই ধারণা। রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ভোটারদের মনোভাব ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা।