একসময় পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন ও শাসনব্যবস্থার কারণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দেড় দশক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল এখানকার মানুষ। জুলাই বিপ্লবের পর সেই সুযোগ ফিরেছে, আর তাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সবাই। ভোটারদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
জেলাটির পাঁচটি উপজেলা মিলে গঠিত চারটি সংসদীয় আসনে সব দলের প্রার্থীরা সক্রিয় থাকলেও তাদের কার্যক্রম ও চ্যালেঞ্জ ভিন্ন ভিন্ন। বৃহত্তম দল বিএনপির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নির্বাচনের আমেজের সঙ্গে সঙ্গে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জেলা বিএনপির নেতারা একসঙ্গে বসতে না পেরে আলাদা কার্যালয়ে দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছেন। মনোনয়ন যেই পান না কেন, বিভক্তি কাটানো কঠিন হবে। তাছাড়া কিছু নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্য দলটির ভাবমূর্তিকে চাপে ফেলছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী অভ্যন্তরীণ সংকটমুক্ত থেকে ইতোমধ্যে শিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং মাঠ পর্যায়ে ভালো সাড়া পাচ্ছে। ইসলামি দলগুলো মোটামুটি ঐক্যবদ্ধভাবেই সক্রিয় আছে।
কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর)
সীমান্তবর্তী এই উপজেলায় বিএনপি অন্তত তিনটি অংশে বিভক্ত। সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপি সভাপতি রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লা এবং সাবেক সদস্য সচিব শহিদুল ইসলাম সরকার মঙ্গল — তিনজন আলাদা আলাদা ধারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিছু নেতার চাঁদাবাজি ও অবৈধ কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি না বদলালে জামায়াত এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
ধানের শীষ প্রতীকের জন্য একাধিক নেতার লবিং চলছে, যেমন— বাচ্চু মোল্লা, শরিফ উদ্দিন জুয়েল, শহিদুল মঙ্গল, নুরুজ্জামান হাবলু ও হাসনাইন নাহিয়ান সজীব। জামায়াত মনোনয়ন দিয়েছে মাওলানা বেলাল উদ্দিনকে। ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও এনসিপি থেকেও প্রার্থী ঘোষণা হয়েছে।
কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর ও ভেড়ামারা)
এ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের অনুসারীরা বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোয় প্রভাবশালী। তবে এবার তিনি মনোনয়ন চাইছেন না। ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী, ফরিদা ইয়াসমিন ও অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম আলমমালিথা মনোনয়নপ্রত্যাশী। সাবেক জোটসঙ্গী আহসান হাবীব লিংকনও ধানের শীষে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতিনিচ্ছেন।
জামায়াত এখানে আবদুল গফুরকে প্রার্থী করেছে, পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস থেকেও প্রার্থী ঘোষণা হয়েছে।
কুষ্টিয়া-৩ (সদর)
এ আসনে কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকারের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের লড়াই চলছে। কমিটিতে সুযোগপ্রাপ্ত কিছু নেতার চাঁদাবাজি এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। তরুণ ভোটারদের একটি অংশ জামায়াতের দিকে ঝুঁকতে পারেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন সোহরাব উদ্দিন, কুতুব উদ্দিন আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার জাকির ও অ্যাডভোকেট শামিম উল হাসান অপু। জামায়াত প্রার্থী মুফতি আমির হামজা, এছাড়াও ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের প্রার্থী ঘোষিত হয়েছে।
কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী ও খোকসা)
দীর্ঘদিন ধরে এ আসনে বিএনপির রাজনীতি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী ও নুরুল ইসলাম আনছার প্রামাণিক। সম্প্রতি শেখ সাদী ও হাফেজ মঈনউদ্দিনের নেতৃত্বে আরও দুটি ধারা তৈরি হয়েছে।
মনোনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা করছেন এই চারজনই। জামায়াত এখানে আফজাল হোসাইনকে প্রার্থী করেছে, পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস থেকেও প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভাজন, নেতাদের অপকর্ম ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব যদি নিরসন না হয়, তবে কুষ্টিয়ায় তাদের পুরনো প্রভাব ফিরে পাওয়া কঠিন হতে পারে।