Saturday, August 16, 2025
spot_imgspot_img
Homeজাতীয়ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি: গোপন কার্যক্রম, হলে রাজনীতি ও ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে উত্তাপ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি: গোপন কার্যক্রম, হলে রাজনীতি ও ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে উত্তাপ

‘এক বড় ভাই প্রথমে আমাকে আলাদা কক্ষে নিয়ে যায়। এরপর আমার বাম হাত মোচড় দিয়ে ধরে রাখে। তারপর বারবার কান আর গালে প্রবল শক্তিতে আঘাত করতে থাকে। এমনভাবে মারধর করা হয়েছিল যে আমার কান থেকে রক্ত বের হয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান তার ‘গেস্টরুম নির্যাতনের’ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এসব বলেন। তার অভিযোগ, ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত না হওয়ায় ২০২৪ সালের শুরুতে তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।

আরিফ জানান, ‘গেস্টরুমে প্রতিদিন যেতে হতো। হলের নিয়ম এটাই। পরীক্ষার সময় হলেও উপস্থিত থাকতে হতো। ভাইয়েরা এলে অনুমতি নিয়ে পড়াশোনা করতে যাওয়া যেত, না হলে খোঁজ শুরু হতো।’

তবে তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গেস্টরুম সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও তার আশঙ্কা—আবাসিক হলে আবার রাজনীতি ফিরে এলে এই গেস্টরুম ও গণরুম প্রথা আবার শুরু হবে।

আরিফ বলেন, ‘এখন আমরা অনেকটা স্বাধীন। প্রতিদিন রাজনীতির কারণে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু হলে রাজনীতি ফিরে এলে তার প্রভাব পড়বেই। আমি বুঝি না, রাজনীতি ক্যাম্পাসে করলে ছাত্রদল, শিবির বা বাম সংগঠনগুলোর কী সমস্যা হয়! হল কমিটি আসলেই আবার গেস্টরুম চালু হবে।’

আরিফের মতো বহু শিক্ষার্থী আগের অভিজ্ঞতার কারণে হলে ছাত্ররাজনীতি চান না। এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও অনেকেই এর বিপক্ষে। সম্প্রতি ছাত্রদল হলে কমিটি ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের একাংশ বিক্ষোভ করে। ভাঙচুরও হয়। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের মৌখিক ঘোষণা দেয়।

কিন্তু এরই মধ্যে ছাত্রদল, ছাত্রইউনিয়ন ও বাম সংগঠনগুলো হলে রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) হলে রাজনীতির বিপক্ষে। ফলে ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক, মতভেদ ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। প্রকাশ্য বনাম গোপন রাজনীতি নিয়েও আলোচনা তীব্র হয়েছে।

অভ্যুত্থানের সময় দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নয় দফায়ও এ দাবি ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক কার্যক্রম দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিরে আসে। সক্রিয় হয় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। দীর্ঘদিন পর ইসলামী ছাত্রশিবিরও প্রকাশ্যে এসে কমিটি ঘোষণা করে।

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একাংশ ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ (বাগছাস) গঠন করে। যদিও তাদের এনসিপির লেজুড় সংগঠন বলে অভিযোগ উঠেছে, নেতারা তা অস্বীকার করেছেন। বাগছাস মুখপাত্র হাসিব আল ইসলাম বলেন, ‘এগুলো অপপ্রচার। আমরা কোনও অভিভাবক সংগঠনের অধীনে কাজ করি না। স্বাধীনভাবে সংগঠন চালাচ্ছি।’

এই সংগঠন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতিকে সমর্থন করলেও হলে রাজনীতির বিরোধী। অন্যদিকে ছাত্রদল হলে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার পক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী বলেন, ‘হলে রাজনীতি না থাকলে ডাকসু নির্বাচনে আমরা কীভাবে কাজ করব? হলে সাংগঠনিক কাঠামো না থাকলে প্রচারণাও সম্ভব নয়। আমরা তো গুপ্ত সংগঠন নই।’

একইভাবে ছাত্রইউনিয়নও হলে কমিটি ঘোষণা করেছে। সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, ‘হলে রাজনীতি নিয়ে ভীতি রয়েছে, আমরা তা বুঝি। তবে হলে সংকট দেখা দিলে সমাধান করে থাকেন হল কমিটির নেতারাই।’

অন্যদিকে অনেক ছাত্রনেতার মতে, হলে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলে গোপন রাজনীতি বাড়বে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘শিবিরকে গোপন রাজনীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনের অবস্থান কী? প্রশাসন কঠোর না হলে গোপন রাজনীতি কখনও বন্ধ হবে না।’

বাগছাসও হলে রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘এখন হলে কোনও কমিটি নেই, তাই চাপও নেই। কিন্তু কমিটি হলে শিক্ষার্থীদের জোর করে প্রোগ্রামে টানা হবে। তাই আমরা চাই, রাজনীতি ক্যাম্পাসেই সীমিত থাকুক।’ তবে তার মতে, হলে রাজনীতি ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে।

হলে রাজনীতির বিষয়ে ছাত্রশিবির মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে। অনেক সংগঠন অভিযোগ তুলেছে যে, শিবির গোপনে কার্যক্রম চালায়। তবে শিবির নেতারা তা অস্বীকার করেন। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমরা বহু কর্মসূচি করেছি ক্যাম্পাসে। হলে থাকা শিক্ষার্থীরাই সেগুলোতে অংশ নিয়েছেন। ছোট ছোট টিম হলগুলোতে কাজ করেছে। সবাই একে অপরকে চেনে।’

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments