গত ২০ জুলাইয়ের ঘটনা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে আসেন এক মধ্যবয়সী নারী। তার হাতের তালুতে তীব্র পোড়া ক্ষত—দেখে মনে হচ্ছিল গরম কিছুতে ছ্যাঁকা লেগেছে। চিকিৎসকরা জিজ্ঞেস করলে সরাসরি উত্তর দিচ্ছিলেন না তিনি; আচরণও ছিল সন্দেহজনক। দুদিন পর আরেক তরুণী একইভাবে হাতের তালু পোড়ার চিকিৎসা নিতে আসেন। পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, দুজনের হাতই কেমিক্যাল দ্বারা পুড়েছে।
এই ঘটনাকে ঘিরে অনুসন্ধান শুরু হলে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর তথ্য। জানা যায়, তারা দুজনেই এক তথাকথিত ‘তান্ত্রিক বাবার’ নির্দেশ মেনে হাত পুড়িয়েছেন। শুধু এই দুই নারী নয়; গত মে থেকে জুলাই—মাত্র তিন মাসে অন্তত ৩০ জন নারী একইভাবে হাতের তালু পোড়ার শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন বার্ন ইউনিটে। তাদের বেশিরভাগই গৃহবধূ বা অবিবাহিত তরুণী। পারিবারিক অশান্তি, স্বামীর অবহেলা কিংবা প্রেমিককে বশে আনার আশায় তারা এই প্রতারণার ফাঁদে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষমেশ উপকার তো হয়নি, বরং হাত পুড়িয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার করে তুলেছেন।
আরও ভয়াবহ বিষয় হলো—সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বা শান্তি ফেরানোর আশায় অনেক নারী ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিওও তুলে দিয়েছেন এই তান্ত্রিক বাবার হাতে। পরে সেগুলো দিয়েই শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল। কেউ হারিয়েছেন টাকা, কেউ হয়েছেন শ্লীলতাহানির শিকার।
ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই প্রতারকের সন্ধান পান। সেখানে ধর্মীয় বা তান্ত্রিক পোশাক পরা একজনের ছবি দিয়ে প্রচার করা হয়: “দাম্পত্য কলহ, প্রেমের সমস্যা, পারিবারিক অশান্তি—সব কিছুর সমাধান!” বিজ্ঞাপনে ফোন নম্বরও দেওয়া থাকে। যোগাযোগ করলে শুরু হয় প্রতারণার আসল খেলা।
এক ভুক্তভোগী নারী জানালেন, স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘদিন মনোমালিন্য চলছিল। বিজ্ঞাপন দেখে নম্বরে কল করলে তাকে বলা হয় বাজার থেকে চিনি ও ‘পটাশ’ কিনতে। পরে নির্দেশ মতো হাতে ধরে রাখতেই হাত ভয়াবহভাবে পুড়ে যায়। আবার ফোন করলে তাকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, মুঠো না ছাড়তে হলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠাতে হবে। টাকা না দেওয়ায় তার হাত গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীরা যে লালচে কালো রঙের পদার্থ ‘পটাশ’ কিনেছিলেন, সেটি আসলে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। চিনির সঙ্গে এটি মিশলে জারণ বিক্রিয়ায় প্রচণ্ড তাপ তৈরি হয়, ফলে হাতের তালু পুড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ইকবাল রউফ মামুন নিশ্চিত করেছেন, এই বিক্রিয়ায় তৈরি পদার্থ এসিডের মতো কাজ করে, যা মানুষের শরীর পোড়াতে সক্ষম।
সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, আব্দুস সবুর নামে এক প্রতারক দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকে একাধিক পেজ খুলে নারীদের এভাবে ফাঁদে ফেলছিল। প্রথমে কেমিক্যাল দিয়ে ভয় দেখিয়ে, পরে নগ্ন ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করত। এক নারীর কাছ থেকে এভাবে ১৪ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেয় সে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের রোগীরা প্রায়ই আসছেন, বিশেষত তরুণী ও অল্পশিক্ষিত নারীরা। বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়েই প্রতারকরা এমন কৌশল চালাচ্ছে।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে ভুক্তভোগীরা লজ্জার ভয়ে মামলা না করায় প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে।