Monday, August 18, 2025
spot_imgspot_img
Homeস্বাস্থ্যচিকুনগুনিয়া সংক্রমণ: ঢাকায়-চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক বিস্তার, জরুরি উদ্যোগের তাগিদ

চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ: ঢাকায়-চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক বিস্তার, জরুরি উদ্যোগের তাগিদ

পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী হিসেবে মশাকেই ধরা হয়। মশাই এমন এক প্রাণী, যে প্রতিবছর সর্বাধিক মানুষের প্রাণ কাড়ে। বিবিসির তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ মশাবাহিত রোগে মারা যায়। এডিস মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ইয়েলো ফিভারসহ একাধিক ভয়াবহ ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে। তাদের হিসেবে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এই দুই রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বছর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ দেখা দেয়।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে সম্প্রতি চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের প্রায় ৭৫ শতাংশের শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হচ্ছে। ঢাকাতেও অনুরূপ পরিস্থিতি বিদ্যমান। যদিও সরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা নেই, ফলে প্রকৃত সংক্রমণের পরিমাণ নির্ধারণে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রথমবার ২০০৮ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলায় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর কয়েক জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে রোগটি শনাক্ত হলেও ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ সময় বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকুনগুনিয়ার জন্য আলাদা কোনো পরীক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় রোগ শনাক্তকরণ সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বেসরকারি ল্যাবগুলোর ওপর, যেখানে খরচ গড়ে ৪ থেকে ৭ হাজার টাকা। ফলে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ পরীক্ষা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র উপসর্গের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে সঠিকভাবে রোগ শনাক্ত না হওয়ায় সংক্রমণ আরও বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

চিকুনগুনিয়া মূলত এডিস এজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। হঠাৎ জ্বর, তীব্র অস্থিসন্ধি ব্যথা, দুর্বলতা, মাথাব্যথা ও র‍্যাশ হলো এর সাধারণ উপসর্গ। শিশু, বৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী রোগীদের জন্য এটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সঠিক সময়ে সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা না পেলে দীর্ঘস্থায়ী জয়েন্ট পেইনের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বর্তমানে উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। জরিপে দেখা গেছে, কিছু এলাকায় এডিস মশার প্রজনন সূচক (BI) ৭৫ পর্যন্ত পৌঁছেছে, যেখানে ২০-এর ওপরে গেলেই সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া চট্টগ্রামে ৭০ শতাংশ মশাই এডিস এজিপ্টাই প্রজাতির, যা ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার প্রধান বাহক।

যেহেতু এই ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন নেই, তাই প্রতিরোধই একমাত্র সমাধান। জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে, তাই নিয়মিত পানি ফেলে দেওয়া, ফুলদানি, টায়ার, ড্রাম বা নির্মাণাধীন ভবনের পানির গর্ত পরিষ্কার করা জরুরি। ব্যক্তিগত সতর্কতার মধ্যে দিনের বেলাতেও মশারি ব্যবহার, পুরো শরীর ঢাকা পোশাক পরা, মশা প্রতিরোধক ক্রিম ও স্প্রে ব্যবহার বিশেষভাবে কার্যকর।

একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের উচিত নিয়মিত ফগিং, লার্ভিসাইড ছিটানো ও গণসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ইতিমধ্যেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাই দ্রুত সরকারি উদ্যোগে সাশ্রয়ী পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা, সমন্বিত মশক দমন কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।

✍️ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার
কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments