ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলোচনার মূল বিষয় ছিল দনবাস অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সমাধান খোঁজা। এরপর সোমবার ওয়াশিংটনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। শুক্রবারের আলোচনায় উঠে আসা প্রস্তাবগুলোই ছিল সেই বৈঠকের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—পুতিন কেন দনবাস অঞ্চল দখল করতে এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ?
রাশিয়ার লক্ষ্য শুরু থেকেই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পসমৃদ্ধ দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক (যা মিলেই দনবাস) এবং দক্ষিণের জাপোরিজঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল দখল করা। তবে পুতিনের সবচেয়ে বেশি নজর দনবাসে। ঐতিহাসিকভাবে রুশভাষী এই অঞ্চলটিকে তিনি যুদ্ধের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরেন এবং এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টিকে রাজনৈতিক ও ভূখণ্ডগত দাবির কেন্দ্রবিন্দু করেছেন।
২০১৪ সাল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তায় দনবাস দখলের চেষ্টা শুরু করে রাশিয়া। পরে ২০২২ সালে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের মাধ্যমে সরাসরি এ অঞ্চল দখল করার উদ্যোগ নেয়। এরপর থেকেই দনবাসে যুদ্ধ চলছে সবচেয়ে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী আকারে। ইউক্রেনীয় গবেষণা সংস্থা ডিপস্টেটের তথ্যমতে, বর্তমানে দনবাসের প্রায় ৮৭ শতাংশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। বাকি অংশ ধীরে ধীরে দখলের চেষ্টা চলছে, যার আয়তন প্রায় ২ হাজার ৬০০ বর্গমাইল। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতি না হলে দনবাসের লড়াই আগামী বছর পর্যন্ত গড়াবে এবং এতে প্রাণহানি বাড়বে আরও কয়েক হাজার মানুষের।
আলাস্কার বৈঠকে পুতিনের প্রস্তাব ছিল—ইউক্রেন তাদের সেনা দনবাস থেকে সরিয়ে নেবে। এর বিনিময়ে রাশিয়া বর্তমান ফ্রন্টলাইনে সংঘাত থামিয়ে দেওয়ার এবং ভবিষ্যতে নতুন আক্রমণ না করার নিশ্চয়তা দেবে। ট্রাম্প জেলেনস্কিকে এ চুক্তি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, দনবাস ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।
দনবাস অঞ্চলের প্রতি রাশিয়ার আগ্রহ নতুন নয়। সোভিয়েত আমলে স্তালিনের শিল্পনীতির ফলে রুশ ভাষাভাষীদের ঢল নামে এ এলাকায়। সোভিয়েত পতনের সময় এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ রুশ ভাষাকেই প্রথম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করত। ২০১০ সালের নির্বাচনে দনবাসের ভোটাররা বিপুলভাবে রুশপন্থী প্রার্থী ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তখন থেকেই পুতিন ক্রিমিয়া দখল করেন এবং দনবাসে বিদ্রোহ উসকে দেন।
বিশ্লেষকদের মতে, পুতিন জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে এবং রুশ জাতীয়তাবাদ উসকে দিতে দনবাস দখলকে অপরিহার্য করে তুলেছেন। তার ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষক কন্সট্যান্টিন রেমচুকভ মনে করেন, যুদ্ধকে ‘সম্পন্ন’ ঘোষণা করতে হলে দনবাসের নিয়ন্ত্রণ পুতিনের জন্য শর্তসাপেক্ষ।
পুতিন দনবাস দখলের পরও ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চলে আগ্রাসন চালাতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা বিশ্লেষকরা। তবে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সীমিত সক্ষমতা রাশিয়াকে বাধ্য করতে পারে আপাতত দনবাস নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে।
কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের বিশেষজ্ঞ তাতিয়ানা স্টানোভায়ার মতে, রুশ সমাজ এখন এমন অবস্থায় আছে যে যুদ্ধের প্রায় যেকোনো ফল মেনে নিতে প্রস্তুত। তাই পুতিন চাইলে দনবাসকেই ‘চূড়ান্ত সাফল্য’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন।