বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ১৯৮০’র দশকের শুরুতে কালিদাস বৈদ্য ও চিত্তরঞ্জন সুতারের নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী নিয়ে হিন্দুদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাদের সহায়তায় ভারতে আশ্রয় নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘বঙ্গসেনা’ নামক সশস্ত্র বাহিনী। এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামেও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে ‘র’। তবে এনএসআই তাদের বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়।
এরপর থেকেই ‘র’-এর প্রধান লক্ষ্য হয় এনএসআইকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তারা সুযোগ পায়, আর ২০০৯ সালের পর থেকে এনএসআই অনেকাংশেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।
২০০৯ সালে মেজর জেনারেল (অব.) মনজুর আহমেদ এনএসআই মহাপরিচালক হওয়ার পর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন:
১) ভারতবিরোধী অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে জেলে পাঠানো (যেমন– ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা)।
২) সৎ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের কোণঠাসা করা।
৩) আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ভারতপন্থি ব্যক্তিদের এনএসআইতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
২০১১ সালে প্রায় এক হাজার জনকে এনএসআইতে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস। এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার স্পেশাল টিমও তদারকিতে ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেই সহকারী পরিচালক পদে ১৪২ জন নিয়োগ পায়, যার বড় অংশ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ পরিবারের সুপারিশপ্রাপ্ত।
তৎকালীন ঢাবি ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মতো ব্যক্তির সুপারিশ ছাড়া প্রবেশপত্র বিতরণই হতো না। মধুর ক্যান্টিন, আওয়ামী লীগ কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভারতীয় দূতাবাস ও ভারতপন্থি সামরিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নিয়োগ তালিকা চূড়ান্ত করা হতো।
নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে ফল প্রকাশ—সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হতো যাতে আগেভাগে নির্বাচিত প্রার্থীরাই টিকে যায়।
সূত্র মতে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চারটি ধাপে গুরুত্ব দেওয়া হতো—চাহিদা নির্ধারণ, পরিকল্পনা, প্রার্থী বাছাই ও নিয়োগ। সবকিছুই হতো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য।
২০১৪ সালের পর লে. জেনারেল শামসুল হক মহাপরিচালক হলে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপক হারে নিয়োগ দেন। পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল (অব.) টিএম জোবায়ের দায়িত্ব নিয়ে সরাসরি অজিত দোভালের সঙ্গে সমন্বয় করে এনএসআইকে ভারতের প্রভাবাধীন করে তোলেন। তার সময়েই এনএসআই কার্যত ‘র’-এর অফিসে পরিণত হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচন বাস্তবায়ন, আন্দোলন দমন ও ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণে এনএসআইকে সরাসরি ব্যবহার করা হয়। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৪০০ জন নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়, যার অনেকেই ছাত্রলীগ ক্যাডার ও ভারতীয় এজেন্ট।
এভাবে এনএসআইয়ের প্রায় প্রতিটি পদ ভারতপন্থি কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠদের দখলে চলে যায়। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা—সবখানেই জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ নিশ্চিত করা হতো। এমনকি ভুয়া সনদধারীরাও চাকরি পেয়েছে।
নিয়োগে অর্থনৈতিক লেনদেনও ছিল প্রকাশ্য। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম নিয়োগপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ৫-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যদিও এনএসআইয়ের তৎকালীন কর্মকর্তারা এসব অভিযোগকে ‘অমূলক’ বলে উড়িয়ে দেন, তবুও বিভিন্ন সূত্রের দাবি—২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এনএসআইয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ।