নির্বাচন, ভোট ও ভোটারদের নিরাপত্তার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সরকার এ দিকটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ ও আনসারের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর প্রায় ৮০ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি মাঠে থাকবে র্যাব, বিজিবি ও নৌবাহিনীও।
এবারের নির্বাচন পরিস্থিতি ভিন্ন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি জনমনে আস্থা জাগিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের আশ্বাস সেই আস্থা আরও দৃঢ় করেছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলে আগ্রহী নয়; বরং তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর দেখতে চায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার কথায় কোনো ‘যদি-তবে’ না থাকায় নির্বাচনকে প্রশ্নমুক্ত করার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নীরব কিন্তু কার্যকর অংশগ্রহণ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। এরপরও নানা সময়ে সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে জনমনে আস্থা সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোতে পুলিশকে দলীয় বাহিনীর মতো ব্যবহারের কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সেনাবাহিনীকে কেবল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখার ফলে ভোট প্রক্রিয়ায় আস্থা ফিরেনি। এবার ভিন্ন বাস্তবতায় জনআকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তা মিলিয়ে সেনাবাহিনীকে সরাসরি সম্পৃক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সেনাবাহিনী জনতার আস্থার প্রতীক হয়ে এসেছে। ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনেও তারা জনতার পাশে দাঁড়িয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, অরাজকতা প্রতিরোধ, কূটনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ নানা ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা দেশের মানুষের কাছে দৃশ্যমান।
বিশ্ব রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বদলাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তারা বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে, আবার পাকিস্তান, তুরস্ক বা মিসরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এখনো বাস্তবতা। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি মধ্যপথে আছে—তারা জনগণের নিরাপত্তায় কাজ করে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, এবারকার নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেবল ‘রেওয়াজ’ নয়, বরং বাস্তবিক প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক চর্চা রক্ষায় ও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সেনাবাহিনীই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় ভরসা।