ভরা মৌসুমে হলেও নোয়াখালীর হাতিয়ার উপজেলার মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরে ইলিশের পাওয়া যাচ্ছেনা। প্রতিবছরের এ সময় নদী ও সাগরে ইলিশের ছড়াছড়ি থাকলেও এবার জেলেরা আশানুরূপ মাছ ধরতে পারছেন না। ফলে জেলে পরিবারগুলো দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। এক সময়ে বর্ষার দিনে ইলিশের গন্ধে উৎসবমুখর হতো বাঙালির ঘর, কিন্তু এখন সেই দৃশ্য অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
সরাসরি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বড় আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০০–২৭০০ টাকায়। এক কেজির নিচের মাছের দামও ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায় পৌঁছেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন হাজারো জেলে নদী ও সাগরে মাছ ধরতে যান, কিন্তু অনেক সময় খালি জাল ফিরছেন। যেসব নৌকায় ইলিশ ধরা পড়ছে, তাতেও শ্রমিকের মজুরি ও জ্বালানি খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
নদীতে মাছ কম থাকায় বাজারে ইলিশের দাম হু-হু করে বেড়েছে। নোয়াখালীর বাজারে দেখা যায়, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ টাকায়, ১.২ কেজির ইলিশ ২৪০০ টাকায়, ১ কেজির মাছ ২২০০ টাকায়, ৮০০ গ্রামের ইলিশ ১৯০০ টাকায় এবং ৬০০ গ্রামের মাছ ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, সাগর ও নদীতে ইলিশ থাকলেও আগের মতো ধরা পড়ছে না। দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে হাজারো জাল, বিশেষ করে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও ফাঁদ জালের কারণে ইলিশ উপরে উঠে আসতে পারছে না। ফলে পদ্মা-মেঘনায় আগের মতো ইলিশ আসে না।
হাতিয়ার বাজারে ইলিশ কিনতে আসা মো. শাহিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “ইলিশ এখন সত্যিই স্বপ্নের খাবার হয়ে গেছে। নদীতে ইলিশ কম থাকায় বাজারের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। মধ্যবিত্তও কিনতে হিমশিম খাচ্ছে, আর দরিদ্রদের পক্ষে ইলিশের দেখা পাওয়া তো দূরের কথা।”
হাতিয়ার জেলে কামাল উদ্দিন মাঝি জানান, “ভরা মৌসুমে এত খালি জাল আগে দেখিনি। ৫০–৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সাগরে গিয়েছি, এখন খরচও উঠছে না। পরিবার চালানোই কঠিন হয়ে গেছে।”
এ অবস্থায় শুধু জেলেরা নয়, শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ইলিশ সরবরাহ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ী, আড়তদার ও বাজারের মাছ ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেক আড়তদার ঋণ করে নৌকা ও জাল জোগাড় করেছিলেন, এখন শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
চেয়ারম্যান ঘাটের মৎস্য আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আকবর হোসেন বলেন, “ভরা মৌসুমেও ইলিশের অভাবে জেলে, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও শ্রমিকরা ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।”
হাতিয়া উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফাহাদ হাসান জানিয়েছেন, “ডুবোচর না থাকা, অনুকূল আবহাওয়া, অতিরিক্ত মাছ শিকার ও পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে ইলিশের প্রজনন ও মজুদে প্রভাব পড়তে পারে। তবে আশা করছি, পরিস্থিতি শিগগিরই উন্নতি করবে।”
ইলিশ গবেষক ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, “ইলিশ পরিভ্রমণশীল মাছ। পথে বাধা পেলেই তারা ফিরে যায়। সাগর-মোহনায় চর-ডুবোচর সৃষ্টি, জলবায়ু পরিবর্তন ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের কারণে নদীতে ইলিশের আগমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিষিদ্ধ জাল নিয়ন্ত্রণ ও নদী দূষণ রোধ ছাড়া সংকট কাটবে না।”