অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব পেশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার কক্সবাজারে আয়োজিত রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপে তিনি এই প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তার মতে, রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন ও বাস্তুচ্যুতি রোধে অবিলম্বে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ড. ইউনূসের প্রস্তাবিত ৭ দফার মধ্যে রয়েছে—রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য রোডম্যাপ তৈরি, আন্তর্জাতিক দাতাদের অব্যাহত সহযোগিতা নিশ্চিত করা, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিতে উদ্যোগ নেওয়া, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংলাপ ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আসিয়ানসহ বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা বৃদ্ধি, গণহত্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহিতা দ্রুত নিশ্চিত করা।
সংলাপটির শিরোনাম ছিল “স্টেকহোল্ডারস’ ডায়ালগ: টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন”, যা রোববার থেকে কক্সবাজারে শুরু হয় এবং সোমবার স্থানীয় হোটেল বে ওয়াচে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমির সঙ্গে তাদের নাড়ির সম্পর্ক অটুট, তাই আর বিলম্ব না করে টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। তিনি আন্তর্জাতিক দাতাদের উদ্দেশে আহ্বান জানান, ২০২৫-২৬ সালের যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার তহবিল ঘাটতি পূরণে তাদের সহায়তা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, আসিয়ান ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে রাখাইন ও সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হতে হবে। একই সঙ্গে মানবপাচার, মাদক ব্যবসা ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের অবৈধ লেনদেন ঠেকাতে উদ্যোগী হতে হবে।
তিনি মনে করিয়ে দেন, রোহিঙ্গা সংকট বৈশ্বিক এজেন্ডায় রাখতে হবে। তারা স্বদেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত থাকা উচিত। তিনি বলেন, গত রমজানে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেসের সঙ্গে কক্সবাজারে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করার সময় প্রত্যেকেরই মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল—যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ফিরে যাওয়া।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গত বছর তার তিন দফা প্রস্তাবের কথা স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, এ বছর সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, কক্সবাজার সংলাপ সেই সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর অবদান রাখবে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে, বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখে। প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পে, অথচ মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখেরও কম। এর অর্থ, চলমান নিপীড়নের কারণে তারা তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।
ড. ইউনূস সতর্ক করেন, যদি বিশ্ব এখনই উদ্যোগ না নেয় তবে রোহিঙ্গারা একসময় নিজ ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি মুছে যাবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সংকটের উৎস মিয়ানমারেই, তাই সমাধানও সেখানেই খুঁজে বের করতে হবে।
রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ সবসময় তাদের পাশে আছে এবং তাদের দ্রুত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনে কাজ চালিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি আহ্বান জানান—ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে।
অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস উপলক্ষে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এসময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, ইউএনএইচসিআরের সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজুসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দলের নেতা, শিক্ষাবিদ ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।