সাম্প্রতিক সময়ে সাকিব রহমানের একটি প্রতিবেদন নেত্র নিউজ-এ ১৬ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে, শিরোনাম: ‘জাতীয় পার্টি কি ভারতীয় রাষ্ট্রের একটি পুতুল?’। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এটি কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা নয়; বরং একটি কেস স্টাডি হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে ভারত অভিযোগ অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গভীরভাবে হস্তক্ষেপ করছে এবং নির্দিষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য দল ও ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।
প্রবন্ধের মূল বক্তব্য হলো, ভারতীয় রাষ্ট্র ঢাকায় তাদের কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে। জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রহমানের অভিজ্ঞতা একটি অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিকোণ প্রদান করে, যা বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান ভারতের প্রভাবের সন্দেহকে আরও দৃঢ় করছে।
রাজনৈতিক প্রমাণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য
রহমানের বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে বিস্তারিত তথ্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার উল্লেখ রয়েছে। তিনি দাবি করেছেন—ভারতীয় হাইকমিশনের চাপের মুখে তাকে দলীয় পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এটি দেখায় কীভাবে বিদেশি হস্তক্ষেপ দলীয় প্রক্রিয়া, গণতান্ত্রিক মানদণ্ড এবং জাতীয় স্বার্থকেও প্রভাবিত করতে পারে।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল পাকিস্তান হাইকমিশনারের বাসায় একটি ছবি তোলার ঘটনায়। রহমানের মতে, এটি সরাসরি একটি ভারতীয় কূটনীতিককে হস্তক্ষেপে প্ররোচিত করে, যিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে তাকে অপসারণে চাপ প্রয়োগ করেন। আরও উদ্বেগজনক হলো, অপসারণের আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা ভারতীয় কর্মকর্তাদের প্রদর্শিত হলেও তাকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। যদি তথ্যটি সঠিক হয়, তবে এটি প্রমাণ করে যে একটি বাংলাদেশি রাজনৈতিক দল কার্যত বাইরের প্রভাবের অধীনে পরিচালিত হচ্ছিল।
জাতীয় পার্টি: দিল্লির খেলায় এক গুটি
একসময় নিজের শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি দল হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টি আজ প্রায় একটি ‘পুতুল’ মাত্র, যার সুতো টেনে চলছে আওয়ামী লীগ ও দিল্লি। রহমানের মন্তব্য এই বিষয়কে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
ভারত বরাবরই বাংলাদেশে প্রক্সি শক্তি গড়ে তুলেছে—কখনো আত্মবিশ্বাসী নেতাদের সমর্থন দিয়ে, কখনো মন্ত্রিসভা গঠনে প্রভাব প্রয়োগ করে, আবার কখনো অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে। জিএম কাদেরের ভারতীয় চাপের প্রমাণ কেবল এটিই নিশ্চিত করে যে বাংলাদেশের বহুদলীয় ব্যবস্থা ক্রমেই একদলীয় খেলায় পরিণত হচ্ছে, যেখানে দিল্লিই রেফারি, কোচ এবং স্কোররক্ষক।
নির্বাচনের উদাহরণ ও অধিকারহীনতা
২০১৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাত সিংহ ঢাকায় এসে তৎকালীন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ দেন। প্রকাশ্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে নির্বাচনে বাধ্য করা হয়। এর ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে, কিন্তু বহুদলীয় অংশগ্রহণের ছাপ কমে যায়। এটি দেখায় জাতীয় পার্টি এখন ভারতের স্বার্থ অনুযায়ী রাজনৈতিক ফলাফল নিশ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, জনগণের স্বাধীন প্রতিনিধিত্ব নয়।
আধিপত্যের ধারাবাহিকতা
প্রবন্ধে কয়েকটি কৌশলগত প্যাটার্ন চিহ্নিত করা হয়েছে—
- কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ: ভারতীয় হাইকমিশন বিরোধী দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করছে।
- দলীয় নিয়ন্ত্রণ: ভারতীয় স্বার্থবিরোধী ব্যক্তিদের সরাতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
- কৌশলগত ব্যবহার: ছোট দলগুলোকে বহুদলীয়তার ভান বজায় রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
- মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: নেতারা বিদেশি অসন্তোষের ভয়ে ভীত, জাতীয় স্বার্থের চেয়ে অনুমোদনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
এই নীতি ‘হেজেমনিক স্টেবিলিটি থিওরি’র সঙ্গে মেলে, যেখানে শক্তিশালী পক্ষ অভিজাত শ্রেণি ও ভিন্নমত দমন করে প্রভাব বিস্তার করে।
হস্তক্ষেপের বিস্তৃত উদাহরণ
জাতীয় পার্টির ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়; বরং ভারতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের অংশ—
- পানি রাজনীতি: তিস্তা চুক্তির ঝুলন্ত অবস্থা বাংলাদেশের খাদ্য ও সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করছে।
- বাণিজ্য সম্পর্ক: ভারতের বাজারভিত্তিক নীতি বাংলাদেশের স্বার্থে বৈষম্য তৈরি করছে।
- সীমান্ত সহিংসতা: বিএসএফের হাতে নাগরিক হত্যাকাণ্ড সীমান্তে অসম শক্তির প্রমাণ।
- রাজনৈতিক আশ্রয়: অতীত প্রশাসনকে সমর্থন দিয়ে গণতান্ত্রিক বৈধতা বিনিময়ে হস্তক্ষেপ।
এই উদাহরণগুলো দেখায়, ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর, অভিযোগ অনুসারে ভারত তাদের কৌশলগত যন্ত্রপাতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ভারতীয় কূটনীতিক, গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়া সহযোগীরা নতুন প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে।
তাদের কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে ড. ইউনূসকে ‘ভারতবিরোধী’ হিসেবে উপস্থাপন, মিডিয়াতে অস্থিতিশীলতার আখ্যান প্রচার এবং প্রান্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে অশান্তি উসকে দেওয়া। অর্থনৈতিক অস্ত্রও ব্যবহার করা হচ্ছে—যেমন বাণিজ্য জট, জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন।
সার্বভৌমত্বের হুমকি
যদি বাইরের শক্তি রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ বা অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নির্ধারণ করতে পারে, তবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সক্রিয়ভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সমালোচকেরা মনে করেন, ভারতের এই হস্তক্ষেপ সফল হলে কোনো সরকার ঢাকায় স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে পারবে না।
জাতীয় সতর্কবার্তা
রহমানের প্রতিবেদনের মাধ্যমে বোঝা যায়, ভারতের প্রভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কতটা প্রবেশ করেছে এবং এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সততা ও স্বায়ত্তশাসন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।