১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে টানা ৪৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। তবে এত দীর্ঘ নেতৃত্বকালেও উত্তরাধিকারের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি কখনো প্রকাশ্যে মত দেননি কিংবা আভাসও দেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ভেঙে পড়ার পেছনে এ ধরনের পরিকল্পনার অভাব অন্যতম কারণ। অন্তর্বর্তী সরকারের নিষেধাজ্ঞায় দলীয় কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও স্পষ্ট ধারণা পাননি, শেখ হাসিনা না থাকলে নেতৃত্ব কোথা থেকে আসবে।
বর্তমানে তিনি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের মাটিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ‘অতিথি’ হিসেবে অবস্থান করছেন। বয়স ও পরিস্থিতির কারণে এবার তিনি উত্তরাধিকার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন। চলতি মাসে শেখ হাসিনা ৭৮ বছরে পা দেবেন।
উত্তরাধিকারের পরিকল্পনা
বিবিসি বাংলার অনুসন্ধান অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আনতে যাচ্ছেন। এছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন। ভারতের কংগ্রেস দলে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মতো দ্বৈত নেতৃত্ব কাঠামোই অনুসরণ করা হচ্ছে।
জয় ও পুতুলের ভূমিকা
সজীব ওয়াজেদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয়। তিনি গণমাধ্যমে নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরছেন। অন্যদিকে মায়ের সঙ্গে একই স্থানে থাকায় সায়মা ওয়াজেদ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন। ভাষণ খসড়া করা, কর্মসূচির সময়সূচি তৈরি থেকে শুরু করে বৈঠক আয়োজন—সবক্ষেত্রেই তিনি জড়িত। গত কয়েক মাসে একাধিক বৈঠকেও অংশ নিয়েছেন।
দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে ছেলেমেয়েদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করছেন।
দলের ভেতরে প্রতিক্রিয়া
বিষয়টি নিয়ে অনেক শীর্ষ নেতা অবগত থাকলেও প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত জানান, “সাকসেসন প্ল্যান এখন আমাদের অগ্রাধিকার নয়। আমরা মূলত বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মনোযোগী।”
কেন রাজনীতিতে আসলেন সায়মা ওয়াজেদ?
২০২৫ সালের ১১ জুলাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদ থেকে সায়মাকে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠায়। অভিযোগ ও বাংলাদেশ সরকারের আপত্তির কারণে তার ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। ফলে তিনি পূর্ণকালীনভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হতে বাধ্য হন। ইতিমধ্যে তিনি সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক পোস্ট ও পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক বার্তা শেয়ার করছেন।
কংগ্রেসের মডেল
ভারতের কংগ্রেসে রাহুল গান্ধী এখন মুখ্য নেতৃত্বে, আর প্রিয়াঙ্কা সহযোগী ভূমিকায় আছেন। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে একই ধরনের কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছেন।
দলে নতুন সমীকরণ
ভারতে থেকেও শেখ হাসিনা দল পরিচালনা করছেন। সায়মা দিল্লিতে, জয় যুক্তরাষ্ট্রে, আর কয়েকজন নেতা কলকাতায় অবস্থান করছেন। এদিকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কার্যত উপেক্ষিত। বরং আসাদুজ্জামান খান কামাল, আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাসিম ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের ওপর বেশি ভরসা করছেন শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদ।
জয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরছেন, আর পুতুল সরাসরি সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
৭৬ বছরের পুরনো আওয়ামী লীগ আজ সংকটময় সময় পার করলেও, নেতৃত্ব এখনও দৃঢ়ভাবে রয়েছে শেখ হাসিনার পরিবারের হাতেই।