Wednesday, September 10, 2025
spot_imgspot_img
Homeআন্তর্জাতিকনেপালের রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের লড়াই: বারবার সরকারের পতনের পেছনের কারণ

নেপালের রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের লড়াই: বারবার সরকারের পতনের পেছনের কারণ


নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে হিমালয়ের চূড়া দেখা যায়, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক আকাশ প্রায়ই অস্থিরতা ও সংকটে ঢাকা থাকে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে নেপালে একাধিকবার সরকার পতন হয়েছে, যা বাইরের পর্যবেক্ষকদের কাছে রহস্যময় মনে হতে পারে। এক সময় দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু সেই গণতন্ত্রের পথ বারবার সরকার পতন, বিক্ষোভ এবং অবিশ্বাসের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাস বোঝার জন্য ১৯৯০ সালের দিকে ফিরে যেতে হবে। দীর্ঘদিন শাহ রাজবংশের শাসন থাকার পর ‘জন আন্দোলন’ বা ‘পিপলস মুভমেন্ট’-এর মাধ্যমে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে রাজা সীমিত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তবে এই পরিবর্তন স্থায়ী হয়নি।

২০০৬ সালে ‘জন আন্দোলন-২’ সংঘটিত হয়, যেখানে মাওবাদী বিদ্রোহী ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। আন্দোলনের ফলে ২০০৮ সালে নেপাল প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের পর থেকে নেপালে ১৩ বার সরকার বদল হয়েছে। এর পেছনে আছে রাজনৈতিক বিভাজন, জোট সরকার ও পারস্পরিক অবিশ্বাস। প্রধান রাজনৈতিক দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি এক সময়ে বিভক্ত হয়ে দুটি ভাগে গঠিত হয়—কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ঐক্যবদ্ধ মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী কেন্দ্র)। পার্থক্য মূলত মতাদর্শ, কৌশল ও ব্যক্তিগত কারণে।

বিভাজনের ফলে কোনো একক দল দীর্ঘমেয়াদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, ফলে বারবার জোট সরকার গঠন হয়েছে। এই জোটগুলো আদর্শগতভাবে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির দলের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ায় দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার ভাগাভাগির সমস্যা তৈরি হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, বিভাজনের রাজনীতির কারণে মন্ত্রীরা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা নেননি। বরং স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ও ক্ষমতার অপব্যবহার নেপালে সাধারণ ঘটনা।

২০১৫ সালে প্রণীত নতুন সংবিধানও বিভাজনের কারণ হয়। বিশেষ করে মধেশী জনগোষ্ঠী সংবিধানের কিছু ধারার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চালায়, দাবি করে তাদের ন্যায্য অধিকার সংবিধানে প্রতিফলিত হয়নি।

ভূ-রাজনৈতিকভাবে নেপাল ভারতের উত্তরে এবং চীনের দক্ষিণে অবস্থান করছে। এই দুই শক্তির প্রতিযোগিতা নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শান্ত বাহাদুর থাপা লিখেছেন, ভারত ও চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা নেপালের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে জটিল করেছে।

সম্প্রতি রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে কাঠমান্ডুতে মিছিল হয়, যেখানে প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র ও ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের পোস্টার প্রদর্শিত হয়। এই আন্দোলন ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রভাব ও নেপালের রাজতান্ত্রিক স্মৃতিকাতরতার সঙ্গে যুক্ত বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের কারণে সামাজিক মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, যা তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভের কারণ হয়। দুই দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের ঘটনা ঘটে।

এই সমস্ত কারণ—রাজনৈতিক বিভাজন, বিদেশি প্রভাব, দুর্নীতি এবং সামাজিক অসন্তোষ—মিলে নেপালের গণতন্ত্রকে বারবার সংকটে ফেলে এবং সরকারের অস্থিরতার চিত্র তৈরী করে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments