২০২২ সালের ২৪ আগস্ট গেজেট আকারে প্রকাশিত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত নগরীতে রূপ দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সামনে আসে। এতে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবনের মানোন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুবিধার মানদণ্ড নির্ধারণ, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়সহ নানা প্রস্তাব রাখা হয়।
তবে ড্যাপ অনুমোদনের আগে ও পরে একাধিকবার সংশোধনী আনা হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছরে এটি হালনাগাদ করার কথা থাকলেও বাস্তবে ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপে বারবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে কার্যকর নগর পরিকল্পনার পথ রুদ্ধ হচ্ছে।
অভিজাত এলাকা যেমন গুলশান-বানানী ও ধানমণ্ডিতে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার মান) কমানোর বিষয়ে পরিকল্পনাবিদদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ফলে বিদ্যমান বৈষম্য বহাল থাকছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত ফার মান প্লট মালিকদের অযাচিত মুনাফার সুযোগ তৈরি করছে। ইতিবাচক দিক হলো—কৃষিজমি, জলাভূমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকায় উন্নয়ন নিষিদ্ধ করার সুপারিশ রাখা হয়েছে।
তবে মূল প্রশ্ন হচ্ছে—ভবনের উচ্চতা বাড়ানো কি নগরের নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতা বাড়াবে? বাস্তবে, যেখানে আগে ৬ তলা ভবন নির্মাণ সম্ভব ছিল, ফার মান দ্বিগুণ হলে সেখানে ১১-১২ তলা ভবন গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এর ফলে আলো-বাতাস প্রবাহ কমে যাবে, পরিবেশও হবে দূষিত।
বহুতল ভবনে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ঢাকা শহরের অধিকাংশ সড়কই ২০ ফুটের কম প্রশস্ত, অনেক সড়ক মাত্র ৬ থেকে ১২ ফুট চওড়া। এসব সরু গলির পাশে ইতোমধ্যেই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ ব্যবহার করে ১০-১২ তলা ভবন তৈরি হয়েছে। আগুন লাগলে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের উপায় নেই। উপরন্তু শহরের বহু জলাশয় ও পুকুর ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির বিকল্প উৎসও আর নেই। ফলে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। অনেক এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করছে। অযাচিত বহুতল ভবন নির্মাণ জনসেবা ও অবকাঠামোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। সরু সড়কে ফার মান বাড়ানোর দাবি আসছে মূলত আবাসন ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে, যাদের একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা বৃদ্ধি। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনগণের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
ফার মান বৃদ্ধি পেলে আবাসন সংকট কিছুটা কমলেও সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে যানজট, জলজট, বিদ্যুৎ-পানি-ড্রেনেজের চাপ, খোলা জায়গার সংকট, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণ। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডে মানুষের জীবনঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাওয়া।
তাই নগরের পরিকল্পনা বা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের সময় নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, পরিবেশবাদী সংগঠন ও কমিউনিটির মতামত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মহাপরিকল্পনা বা ড্যাপ কোনোভাবেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপে পরিবর্তিত হওয়া উচিত নয়। বরং জনকল্যাণ, বাসযোগ্যতা, পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণ, কৃষিজমি-জলাশয় রক্ষা এবং এলাকাভিত্তিক সমতার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান
অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)