আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পর্যবেক্ষণ শেষে ৮৫ পৃষ্ঠার একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে প্রকল্পটির নানা নিরাপত্তা ঘাটতি এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংস্থাটির মূল্যায়নে বলা হয়েছে—যন্ত্রপাতির অপূর্ণতা, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্বল প্রস্তুতি, বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ঘাটতি, প্রশিক্ষণের অভাব এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় চরম অব্যবস্থাপনা রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অনিরাপদ করে তুলেছে। আইএইএর মতে, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী (৬ নভেম্বর) ফুয়েল লোডিং শুরু হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—এই পরিস্থিতিতে কার্যক্রম শুরুর তাড়াহুড়ো শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন নয়, রূপপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকেও মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
সূত্র জানায়, গত ১০ থেকে ২৭ আগস্ট আইএইএর একটি বিশেষজ্ঞ দল রূপপুর প্রকল্পে মিশন চালায়। পরে সংস্থাটি ওয়েবসাইটে একটি প্রেস নোট প্রকাশ করে, যেখানে উন্নতি ও প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা ঘাটতির কথা স্পষ্ট করা হয়। অথচ রূপপুর কর্তৃপক্ষ এই নোটকেই সম্পূর্ণ প্রস্তুতির প্রমাণ হিসেবে প্রচার করছে।
কালবেলার হাতে আসা গোপন প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নকশা অনুযায়ী পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা পরীক্ষা (Primary Circuit, Containment, Biological Shielding, Fuel Pellet ও Fuel Rod Cladding) যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি। Compressed Air, Nitrogen-Oxygen Generation, Standby Power, Water Intake System, HVAC System, Radiation Monitoring, Fire Detection, Control Valve, Ventilation System, Pump ও Power Supply-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট সিস্টেমও এখনো অসম্পূর্ণ। হাজার হাজার সেন্সর ও যন্ত্রাংশ ঠিকভাবে বসানো হয়নি।
আইএইএর ধাপে ধাপে পরীক্ষার (Stage A0-D) নির্দেশনা মানা হয়নি। যেমন, A0 সাব-স্টেজে ৫৫৯টি কাজের মধ্যে শেষ হয়েছে মাত্র ১৬টি। A1 সাব-স্টেজে ১১৮৭টির মধ্যে শেষ হয়েছে ৯৯টি। অনেক সাব-স্টেজ পুরোপুরি স্থবির অবস্থায় রয়েছে। ফিজিক্যাল স্টার্টআপের আগে সম্পন্ন হওয়ার কথা ১৭৪৬টি কাজের মধ্যে শেষ হয়েছে মাত্র ১৭১টি।
প্রতিবেদনটির ৫৩-৫৬ নম্বর পাতায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রটির জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা প্রায় অপ্রস্তুত। বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় জরুরি সুবিধাগুলো এখনো নির্মাণাধীন, ডিজেল জেনারেটর, পানি সরবরাহ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রতিক্রিয়া দল কার্যকরভাবে প্রস্তুত নয়। জরুরি ড্রিলও হয়নি পুরোপুরি। এর ফলে দুর্ঘটনার সময় সঠিক সমন্বয় ও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
অন্যদিকে, প্রতিবেদনের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিকিরণ সুরক্ষা ব্যবস্থায় ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ নয়। রেডিওলজিক্যাল এলাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থাও কার্যকর নয়।
এ ছাড়া Cold Run ও Hot Run পরীক্ষাগুলো সম্পূর্ণ হয়নি, ফলে ফুয়েল লোডের আগে নিরাপত্তা সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্ধারিত ধাপের কাজ বাকি রেখেই ফুয়েল লোডের চেষ্টা করলে রেডিওলজিক্যাল জটিলতা এবং নিউক্লিয়ার অপারেশনে ভয়ংকর ঝুঁকি তৈরি হবে।