দ্রুতগতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্টারলিংক’ নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনার ঝড়। বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স পরিচালিত এই সেবা সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) থেকে নিবন্ধন পাওয়ার পর দেশে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পূর্ণাঙ্গভাবে সেবা চালু হলে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের ধারা আমূল বদলে যাবে। তবে এজন্য স্টারলিংককে আগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) লাইসেন্স পেতে হবে এবং একইসঙ্গে নির্মাণ করতে হবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো—যার মধ্যে গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন অন্যতম প্রধান শর্ত।
স্টারলিংক এ বিষয়ে দেশের একাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোপনীয়তার ভিত্তিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি অংশীদার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ বা গোপনীয়তা চুক্তি করছে, ফলে নির্দিষ্ট করে কারা অংশ নিচ্ছে তা প্রকাশ্যে আসছে না। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ এই অংশীদারত্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মঈনুল হক সিদ্দিকী এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, তিনি জানিয়েছেন যে স্টারলিংক তাদের কিছু অবকাঠামো ব্যবহার করতে পারে বলে শুনেছেন।
স্টারলিংকের অগ্রযাত্রা কেমন হচ্ছে?
বিভিন্ন সূত্র বলছে, স্টারলিংক আগামী জুন বা জুলাই মাসের মধ্যেই তাদের বাণিজ্যিক সেবা চালু করতে পারে। প্রাথমিকভাবে ব্যান্ডউইথ ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা দিয়ে যাত্রা শুরু হবে, মোবাইল ইন্টারনেট সেবা এখনই আসছে না। প্রথম টার্গেট থাকবে দেশের বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠান, যারা নিরবচ্ছিন্ন ও উচ্চগতির কানেক্টিভিটি খুঁজছেন। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও থাকবে তাদের অগ্রাধিকার তালিকায়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাণিজ্যিক সেবা শুরুর আগে দেশে একাধিক গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হবে। এর জন্য ইতিমধ্যে গাজীপুরের কালিয়াকৈর, কক্সবাজার, যশোর ও চট্টগ্রামে সম্ভাব্য স্থানগুলো পরিদর্শন করেছে স্টারলিংক। জমি নির্ধারণ, বিদ্যুৎ সংযোগ এবং কানেক্টিভিটি—সব বিষয়েই কঠোর গোপনীয়তার সাথে আলোচনা চলছে।
ফাইবার অ্যাট হোমের সম্ভাব্য ভূমিকা
গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ ছাড়াও ট্রান্সমিশন, ব্যান্ডউইথ, কানেক্টিভিটি এবং ডাটা সেন্টার ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্টারলিংককে সহযোগিতা করতে পারে ফাইবার অ্যাট হোম। গাজীপুর হাইটেক পার্কে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির ডাটা সেন্টারের কয়েকটি র্যাক ব্যবহার করবে স্টারলিংক। এছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ডাটা ট্রান্সমিশনের জন্যও ফাইবার অ্যাট হোম থেকে সহায়তা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
২০০৯ সালে সরকারের দেওয়া এনটিটিএন লাইসেন্সের আওতায় ফাইবার অ্যাট হোম সারা দেশে ৬০ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। তারা ‘ইনফো সরকার ২’ ও ‘ইনফো সরকার ৩’ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করেছে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, খোলামেলা জায়গা, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ এবং নিরাপত্তা যেখানে থাকবে, সেখানে গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করলেই স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল সহজে গ্রহণ ও পরিবেশন করা যাবে। এর ফলে সাবমেরিন কেবল বা এনটিটিএন অপারেটরের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে। সাধারণত প্রতিটি স্টেশন ৯টি হাই-পারফরমেন্স অ্যান্টেনা দ্বারা গঠিত হয়, যা লো-আর্থ-অরবিট স্যাটেলাইট থেকে সরাসরি সিগন্যাল গ্রহণে সক্ষম।
এই ডাটা সাবমেরিন কেবল বা আইটিসি অপারেটরদের মাধ্যমে দ্রুত ডাটা সেন্টারে পৌঁছে যাবে, যেখানে তা প্রক্রিয়াজাত হয়ে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছাবে।
দেশীয় আইএসপিদের চিন্তাভাবনা
স্টারলিংক সেবা চালু হলে দেশের দুর্গম ও গ্রামীণ অঞ্চলে ডিজিটাল বৈষম্য কমবে এবং শিক্ষাসহ উদ্যোক্তাবান্ধব নতুন সুযোগ তৈরি হবে—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, “নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। তবে স্টারলিংক আমাদের মতো সাশ্রয়ী দামে সেবা দিতে পারবে না, তাই তাদেরকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছি না। করপোরেট প্যাকেজের ক্ষেত্রে কিছু ক্ষতি হতে পারে।”
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক, যাতে দেশীয় উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।