বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংবিধান সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া হিসেবে পরিচিত। বর্তমান সময়ে, প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর ফলে সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এই প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাব্য সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে।সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা উচিত। যদিও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টির প্রতি সম্মতি প্রকাশ করেছে, তবে এই ভারসাম্য কীভাবে আনা হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখনও শুরু হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক সংলাপের মাধ্যমে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করবে, যেখানে এই সুপারিশগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।বিএনপি ইতোমধ্যেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে বিএনপি এবং অন্যান্য দলগুলি এখনও এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন কিভাবে হবে, সে ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলেনি। যাই হোক, সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি পরিস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিশনটি বেশ কিছু সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার কথা বলেছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর দেওয়া হবে। এসব নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের প্রয়োজন হবে না, ফলে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হবে।এছাড়া, সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ গঠনেরও প্রস্তাব দিয়েছে, যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পদে নিয়োগ দেয়া হবে। এ ধরনের পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে আর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না, বরং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই নিয়োগগুলি হবে।বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন, তবে তার আগেই প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর নিতে হয়। তবে সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে যে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার জন্য রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের জন্য শুধুমাত্র জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এর মানে হল যে, প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষেত্রে আর থাকবে না।সংবিধান সংস্কার কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একই ব্যক্তি সংসদ নেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারবেন না। এটি সংবিধানে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হবে, যা সরকারের ভিতরের ক্ষমতার ভারসাম্য বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। বর্তমানে, বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এক ব্যক্তিই থাকেন। এই পরিস্থিতিতে, সরকারের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং অন্য অংশগুলোর ভূমিকা ক্ষীণ হয়ে পড়ে।সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে। বর্তমান পদ্ধতিতে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সাধারণভাবে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে মনোনীত প্রার্থীর মাধ্যমে। তবে সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন একটি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) ভোটে। এ ক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের ভোটের পাশাপাশি জেলা ও সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিলের ভোটও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।এছাড়া, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য শুধুমাত্র সংসদের ভোটই যথেষ্ট, কিন্তু নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, অন্যান্য স্থানীয় কাউন্সিলগুলোও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, যার ফলে একটি আরো সমন্বিত এবং বিস্তৃত নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত হবে।বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, গণতন্ত্র মঞ্চ এবং সিপিবি (কমিউনিস্ট পার্টি) সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। তবে, কমিশনগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় দলের নেতারা এখনো বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানাননি। বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলো বলছে যে, কমিশনগুলোর সারসংক্ষেপ প্রকাশের পর তারা নিজেদের দলে ব্যাপক পর্যালোচনা করছেন এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের মতামত জানাবেন।অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করতে চায়, যেখানে এই সুপারিশগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। দলের নেতারা এবং সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন যে, সংলাপের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা সম্ভব হবে।সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে, একদিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, তবে অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমে যাবে। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার সম্পর্ক অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত হতে পারে। তাই, এসব পরিবর্তন বাস্তবায়নের পর রাষ্ট্রপতির স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা কতটুকু থাকবে, তা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া সফল হতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের প্রস্তাব বাস্তবায়নে নির্ভুল পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে।