এআই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দুনিয়াতেই বড় ধরনের ঝামেলার কারণ হতে পারে। এমন এক সময় আসতে পারে, যখন নির্দোষ মানুষকে অপরাধী বানানো হবে, আবার আসল অপরাধীও দিব্যি নির্দোষ সাজতে পারবে। তখন সত্যটা আড়ালেই থেকে যাবে। পাথর ইস্যু যেন সেই ভবিষ্যৎ বিপদেরই ঝলক। কারবারিরা কাজটা আগেই সেরে ফেলেছে। পাথর লুট চলছে বহুদিন ধরেই। যেসব উত্তোলনকারী এতে যুক্ত, তারা ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে মাসের পর মাস দৌড়ঝাঁপ করেছে, আর তাতে কিছুটা সফলও হয়েছে।
এবারের শোকের মাসেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে হাঁস আর পাথর। যেমন আতর-বাঁশ বা মৌসুমি ফলের মৌসুম থাকে, তেমনি রাজনীতিতে হঠাৎ হঠাৎ বিশেষ প্রাণী বা বিশেষ জিনিস আলোচনায় চলে আসে। আগস্ট মাস তো বটেই, একদিকে শোক, অন্যদিকে রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পঁচাত্তরের আগস্টে যেমন ‘হাঁস’ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল, আজও তেমনই নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তবে প্রেক্ষাপট একেবারেই আলাদা। এখন আর শীতকাল না হলেও হাঁস খাওয়ার ধুম সারা বছরই চলছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন কূটনীতিক পিটার হাসকে ঘিরে আলোচনা।
এর মধ্যেই আলোচনায় এলো উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ‘হাঁসকাণ্ড’। সমান্তরালে ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে পাথর লুটের ঘটনাও রাজনীতিতে বড় প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিটফোর্ডে পাথর দিয়ে এক যুবককে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই এই চুরির ঘটনা সামনে আসে। ফলে মনে হচ্ছে, রাজনীতি মানেই এখন হাঁস আর পাথর—যেন বাংলাদেশের একমাত্র ইস্যু। অথচ মূলত আলোচনায় থাকার কথা নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচন কমিশন ব্যস্ত রোডম্যাপ চূড়ান্ত করতে, রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ডুবে আছে। কিন্তু রাজনীতি যেন এখন হাঁস-পাথরের অতিখেলায় মেতেছে।
পাথর চুরির ঘটনাও রহস্যে ভরা। শত শত ট্রাকভর্তি সাদা পাথর চুরি গেল, আবার যৌথ বাহিনী উদ্ধারও করল অনেক। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—চোর কে, চোরের মাথা কে? প্রশাসন তখন কোথায় ছিল? ডিসি-এসপি কিংবা ওসিরা, যারা এ ধরনের পোস্টিংয়ের জন্য লবিং করে, তারা কি কিছুই জানত না? আদালতকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হলো। অথচ এগুলো দমন করার দায়িত্ব সরকারেরই।
একইভাবে হাঁস প্রসঙ্গও আলোচিত হয়েছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। সজীব ভূঁইয়া স্বীকার করেছেন, প্রায়ই রাতভর কাজ শেষে ভোরে তিনি ৩০০ ফিট এলাকার নীলা মার্কেটে গিয়ে মাটির চুলায় রান্না হাঁসের মাংস খান। মার্কেট বন্ধ থাকলে তিনি গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে যান। এই প্রসঙ্গে আবার তার নাম এসেছে চাঁদাবাজি মামলার এক ভিডিও বার্তায়। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, হেলমেট পরা কাউকে দেখে যদি তাকে বলা হয়, সেটা আসলে কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
প্রশ্ন হলো—এসব কি এখন আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত? সাধারণ মানুষের দিনযাপন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, নির্বাচনের প্রস্তুতি—এসবের চেয়ে হাঁস-পাথর নিয়েই যেন ব্যস্ততা বেশি। পরিবেশ উপদেষ্টা ভোলাগঞ্জের পাথর লুট ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তবে এটি কি কেবল তার ব্যর্থতা, নাকি পুরো সরকারের? সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারও প্রশ্ন তুলেছেন—দেশের অন্য জায়গায় যখন পাথর তোলা যায়, সিলেটে কেন যাবে না? ফলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
রাজনীতির আসল ইস্যুগুলো যখন আড়ালে চলে যাচ্ছে, তখন হাঁস-পাথরের মতো তুচ্ছ প্রসঙ্গেই যেন সবাই আটকে আছে। অথচ ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যে ঘোষণাপত্র দিয়েছেন, সেটি রাজনৈতিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবু সেটি নিয়ে বিতর্ক কম, বরং হাঁস-পাথরের হুজুগেই সময় কাটছে।
রাজনীতির এই নাটকীয় অবস্থা যেন ‘মহাসার্কাস’। পাথর উদ্ধার, চোর ধরার নামে ভুয়া ছবি কিংবা হাঁস খাওয়ার গল্প—এসবেই ভরে গেছে আলোচনার মঞ্চ। ফলে বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—দেশ আসলে কোনদিকে যাচ্ছে?