Sunday, August 17, 2025
spot_imgspot_img
Homeজাতীয়মালয়েশিয়া সফরে অভিবাসন, বিনিয়োগ ও কূটনীতিতে নতুন দিগন্ত

মালয়েশিয়া সফরে অভিবাসন, বিনিয়োগ ও কূটনীতিতে নতুন দিগন্ত

২০২৫ সালের ১১ থেকে ১৩ আগস্ট মালয়েশিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্রীয় সফর দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। এটি ছিল ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ দ্বিপাক্ষিক সফর, যা গত বছরের অক্টোবরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের ঢাকা সফরের প্রতিদানস্বরূপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সফর কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে আরও গভীর করার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। আলোচনায় বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রমবাজার, শিক্ষা, পর্যটন ও প্রতিরক্ষা খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর মালয়েশিয়া তাদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। এ সফরে অভিবাসন ইস্যুতে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। পূর্বে এই শ্রমবাজারে নানা সমস্যা যেমন ভিসা জটিলতা, শ্রমিক শোষণ ও কর্মপরিবেশের ঘাটতি বিদ্যমান ছিল। তবে এবার স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলো একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা শ্রমশক্তি ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও নিরাপদ করবে। এতে বৈধ উপায়ে শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ বাড়বে এবং তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ফলে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স পাবে বৈধ পথে, আর মালয়েশিয়া পাবে দক্ষ জনশক্তি।

এই সফরে মোট পাঁচটি সমঝোতা স্মারক এবং তিনটি ‘নোট অব এক্সচেঞ্জ’ সই হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, জ্বালানি, শিক্ষা ও গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং হালাল ইকোসিস্টেম সম্পর্কিত চুক্তি। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দুই দেশের সামরিক সক্ষমতাকে শক্তিশালী করবে, জ্বালানি চুক্তি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে, আর শিক্ষা ও গবেষণার সমঝোতা শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের চুক্তি আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগের পরিবেশকে সহজ করবে। হালাল ইকোসিস্টেমে সহযোগিতা বাংলাদেশের পণ্যের জন্য বৈশ্বিক বাজারের নতুন দরজা খুলে দিতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রত্যাশিত বিষয় ছিল রোহিঙ্গা সংকট। ড. ইউনূস এ ইস্যুতে মালয়েশিয়ার সহযোগিতা চান এবং প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আলোচনার উল্লেখযোগ্য দিক ছিল মালয়েশিয়ার মিয়ানমারে যৌথ শান্তিরক্ষা মিশন পাঠানোর ঘোষণা। আসিয়ানভুক্ত দেশ হিসেবে মালয়েশিয়ার এ পদক্ষেপ মিয়ানমারের ওপর অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টি করবে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবে।

উচ্চশিক্ষা ও কূটনীতিক প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত সমঝোতাগুলোও ভবিষ্যতের সহযোগিতা জোরদার করবে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাবে, আর দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে সরাসরি বোঝাপড়া বৃদ্ধি পাবে।

ড. ইউনূসের এ সফর প্রমাণ করেছে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বেও সুচিন্তিত কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। অভিবাসন খাতে স্বচ্ছতা, বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত, হালাল বাজারে প্রবেশের সুযোগ এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার সমর্থন বাংলাদেশের জন্য আশার আলো হয়ে এসেছে।

এটি শুধু একটি দ্বিপাক্ষিক সফর নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা ও অবস্থানকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আশা করা যায়, এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্ক আরও গভীর, টেকসই ও ফলপ্রসূ হবে।

— ড. সুজিত কুমার দত্ত
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
✉️ datta.ir@cu.ac.bd

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments