Thursday, August 21, 2025
spot_imgspot_img
Homeজাতীয়২৩ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি: ব্যাংকিং খাত গভীর সংকটে

২৩ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি: ব্যাংকিং খাত গভীর সংকটে

দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতের ভেতরের প্রকৃত সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ২৩টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এ সময় এসব ব্যাংকের মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ১৯টি ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। তবে সে সময় ২৮টি ব্যাংককে ডেফারেল সুবিধা দেওয়ায় ঘাটতি কিছুটা কমে আসে। যদিও জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মোট ঘাটতির অঙ্ক কমেছে, ঘাটতিগ্রস্ত ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে। মার্চ শেষে এ ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে।
জনতা ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা পাওয়ায় ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে—ডিসেম্বরের ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা থেকে মার্চে ১২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। তবে অগ্রণী ব্যাংক সুবিধা নেওয়ার পরও তার ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮২২ কোটি টাকায়। রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি সুবিধা নিয়ে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৭০ কোটি টাকায়।

বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ডেফারেল সুবিধা নিয়েও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায়। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) কোনো সুবিধা না পেয়ে ২ হাজার ৫১১ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে।

ইসলামি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ইউনিয়ন ব্যাংক, যার ঘাটতি মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকায় (ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা)। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ৭ হাজার ৭৯০ কোটি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ৬ হাজার ৪৫৪ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৮১ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৯৮০ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১ হাজার ৪৯৯ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকের ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া বাকি সবাই ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে।

আইএফআইসি ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা নিয়ে ডিসেম্বরের ৯ হাজার ২৯ কোটি টাকা থেকে ঘাটতি কমিয়ে মার্চে ২ হাজার ৬৯৮ কোটিতে নামিয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকও সুবিধা নিয়ে ডিসেম্বরের ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি থেকে মার্চে ঘাটতি কমিয়ে এনেছে ৬ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকায়। তবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সুবিধা নিয়েও ঘাটতি বাড়িয়ে ১ হাজার ৭৮২ কোটি টাকায় নিয়ে গেছে। এবি ব্যাংকের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকায়, যা ডিসেম্বর শেষে ছিল মাত্র ৫০০ কোটি। পদ্মা ব্যাংক কোনো সুবিধা না পেয়ে ডিসেম্বরের ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি থেকে মার্চে ঘাটতি বাড়িয়ে ৫ হাজার ১৭১ কোটিতে তুলেছে।

এর বাইরে নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে কয়েকটি ব্যাংক। প্রিমিয়ার ব্যাংক মার্চে ১ হাজার ১৭১ কোটি, সীমান্ত ব্যাংক ২৬ কোটি, ইউসিবি ৯৫৪ কোটি, সিটিজেন ব্যাংক ৮৬ কোটি এবং বিদেশি হাবিব ব্যাংক ৩৬ লাখ টাকার ঘাটতিতে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের সিআরএআর কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশে, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যূনতম ১০ শতাংশ থাকা উচিত। ডেফারেল সুবিধা না থাকলে সিআরএআর ঋণাত্মক হয়ে যেত—প্রায় ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এদিকে খেলাপি ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি আরও বাড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক খাত ভয়াবহ সংকটে আছে। ডেফারেল সুবিধা সাময়িক চাপ কমালেও এটি মূল সমস্যার সমাধান নয়। দুর্বল ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাত অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। দ্রুত সংস্কার, জবাবদিহি এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পুরো অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments