দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ভয়াবহ ধস নেমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি কমেছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন এবং রপ্তানি কমেছে ৭৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন। এ পরিস্থিতির কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসা, পরিবহন ও শ্রমিক খাত।
আগে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রায় ৫৫০–৬০০ ট্রাক পণ্য আমদানি এবং ২৫০–৩০০ ট্রাক রপ্তানি হতো। বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে আমদানিতে ২৫০–৩০০ ট্রাক এবং রপ্তানিতে ১০০ ট্রাকেরও নিচে। ফলে দুই দেশের বন্দর এলাকায় গুদাম, পরিবহন, হ্যান্ডলিং শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমদানি-নিষেধাজ্ঞা ও ট্রাক চলাচলে বাধা এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
ব্যবসা ও শ্রমজীবীদের সংকট
বেনাপোলের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অভিযোগ, ভারতের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কেন্দ্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ইতোমধ্যেই অনেক সিঅ্যান্ডএফ অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, বহু কর্মচারী ও শ্রমিক বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। একই অবস্থা ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে—সেখানে শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছেন এবং স্থলপথে বন্ধ থাকা আমদানি পুনরায় চালুর দাবি জানাচ্ছেন।
পরিসংখ্যান
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে ২১ লাখ ৩০ হাজার ২২৮ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৮ মেট্রিক টনে। রপ্তানিও কমেছে; আগের বছর ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬৭২ মেট্রিক টন থেকে এবার দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টনে।
জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৫৫ হাজার ৩৯০ ট্রাক পণ্য, আর রপ্তানি হয়েছে ২১ হাজার ৭৩৮ ট্রাক পণ্য। চলতি আগস্টে ২ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ৩,৯৮৪ ট্রাক এবং রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭২২ ট্রাক।
প্রভাবিত খাত
বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে—শিল্প কারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাকের কাঁচামাল, শিশু খাদ্য, টায়ার, মেশিনারিজ, ওষুধ কাঁচামাল, কেমিকেল, ফল, পেঁয়াজ, চাল, ডাল, সুতা ও তুলা। আর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—পাট ও পাটজাত দ্রব্য, তৈরি পোশাক, গার্মেন্টস সামগ্রী, কেমিকেল, টিসু, মেলামাইন ও মাছ। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারির কারণে এ সকল বাণিজ্য অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।
উদ্বেগ ও সমাধানের দাবি
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আলহাজ মহসিন মিলন বলেন, “৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বাণিজ্য ধসে পড়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্রুত নীতিগত সমাধান ছাড়া এই সংকট কাটানো কঠিন হবে।”
ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা অরুণাভ পোদ্দার জানান, “বাণিজ্য বন্ধ থাকায় লোড-আনলোড পুরোপুরি থমকে গেছে। অনেক শ্রমিক এখন দিনে ১০০ টাকারও কম আয় করছেন।”
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক মো. শামিম হোসেন বলেন, দুই দেশের সরকার কিছু পণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন আমদানি-রপ্তানি অনেক কম।
সার্বিক চিত্র
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে হলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে চলমান নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে বন্দর এলাকায় স্থবিরতা আরও গভীর হবে এবং উভয় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।