গ্রিনল্যান্ড, বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ, যা বর্তমানে ৮০ শতাংশ বরফে ঢাকা, তার অধীনে লুকিয়ে থাকা সম্পদের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা বাড়ছে। এই বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে রয়েছে বিরল খনিজ, জীবাশ্ম জ্বালানি এবং সবুজ প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য খনিজ, যা বিশ্বজুড়ে বিশেষত উন্নত দেশগুলোর নজর কাড়ছে। একদিকে, এই সম্পদের সম্ভাবনা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে গ্রিনল্যান্ডকে তাড়িত করছে, অন্যদিকে এর উত্তোলন এবং পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।
গ্রিনল্যান্ডের ইতিহাস দীর্ঘ, প্রায় এক হাজার বছর আগে এরিক দ্য রেড ভাইকিং নাবিক প্রথম ইউরোপীয় বসতি গড়েছিলেন এখানে। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী এখানে কৌশলগত ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। তবে বর্তমানে, এই বরফের তলায় লুকানো খনিজ এবং অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ খুঁজে বের করতে অনেক শক্তিশালী দেশ গ্রিনল্যান্ডের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেখানকার অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে অনেক মূল্যবান খনিজ, যার মধ্যে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (Rare Earth Elements) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই খনিজগুলি ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি, সোলার প্যানেল, ড্রোন প্রযুক্তির মতো আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।
তবে, এই সম্পদের উত্তোলন সহজ কাজ নয়। গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান, এর দুর্ভেদ্য পরিবেশ এবং কঠিন ভূতাত্ত্বিক অবস্থা খনিজ উত্তোলনকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘ সময়, শক্তিশালী অবকাঠামো এবং পরিবেশগত অনুমোদনের বিষয়গুলি গ্রিনল্যান্ডের খনিজ উত্তোলনকে কঠিন করে তোলে। বিশেষত, ইউরেনিয়াম এবং অন্যান্য তেজস্ক্রিয় খনিজের সঙ্গে এই খনিজগুলি সম্পর্কিত, যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২১ সালে গ্রিনল্যান্ড সরকার ইউরেনিয়ামের উত্তোলন সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে কিছু খনি বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া, গ্রিনল্যান্ডে জলবায়ু পরিবর্তন তীব্রভাবে প্রভাব ফেলছে। এখানকার হিমবাহ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন টন বরফ হারাচ্ছে। যদিও হিমবাহ গলে নতুন ভূখণ্ড উন্মুক্ত হচ্ছে, এটি খনির জন্য ততটা প্রাসঙ্গিক নয়। তবে, আর্কটিক সমুদ্রপথের বরফ হ্রাস খনিজ পরিবহনকে সহজ করে তুলছে, যা প্রযুক্তি তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।
গ্রিনল্যান্ডের স্থানীয় বাসিন্দারা খনির সুযোগকে একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হিসেবে দেখলেও, তারা এতে পরিবেশগত এবং সামাজিক ঝুঁকি মনে করছেন। তাদের মতে, এখানে জমির মালিকানা সরকার হাতে থাকলেও স্থানীয়রা প্রকল্পের সহ-মালিকানা চায় এবং তাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনও বলেছেন, ‘গ্রিনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ এর মানুষের হাতে।’ তবে, আন্তর্জাতিক চাপ এবং বড় শক্তির লোভ এখানকার নীতিগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।
গ্রিনল্যান্ড বর্তমানে একটি জটিল অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে, এটি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য পদক্ষেপ নিতে চায়, অন্যদিকে, এটি প্রকৃতির সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হবে। এই দ্বীপের ইতিহাস শুধুমাত্র খনিজ সম্পদ নয়, বরং মানব সভ্যতার লোভ এবং প্রকৃতির ভারসাম্যের দ্বন্দ্বের এক অমোঘ গল্প বলছে। বরফের নিচে লুকানো সম্পদ হয়তো বিশ্বকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তার মূল্য কতটা, তা এখনো অনিশ্চিত