Thursday, May 1, 2025
spot_imgspot_img
Homeজাতীয়বেবিচকের লুটপাটের কর্মকাণ্ড যার নেতৃত্বে চলছে, তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে।

বেবিচকের লুটপাটের কর্মকাণ্ড যার নেতৃত্বে চলছে, তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) আওতাধীন দেশের বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়নের নামে এক বিশাল লুটপাটের মহোৎসব চলেছে, যা বর্তমানে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত। এই লুটপাটের নেতৃত্বে ছিলেন বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান, যিনি অত্যন্ত বিতর্কিত এক চরিত্র। তার নেতৃত্বে, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নামে শত শত কোটি টাকা চুরির ঘটনা ঘটেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে এই দুর্নীতির বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে, যা দেশের স্বার্থে চরম ক্ষতিকর ছিল।

বেবিচকের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ইতোমধ্যে সাবেক বিমান সচিব মহিবুল হক, সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, সাবেক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক এবং বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা আসামি হয়েছেন। এদের মধ্যে সাবেক বিমান সচিব মহিবুল হক গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন, অন্যদিকে সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তবে বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান এখনও তার পদে বহাল আছেন, যা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

দুদকের তদন্ত অনুযায়ী, হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং তৎকালীন সরকারের সহায়তায় বেবিচকের বিভিন্ন প্রকল্পে একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। তার আমলে, বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়ন কাজে অনেক বড় বড় প্রকল্পের বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন যথেষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্প হলো সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প। এছাড়া, কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে শক্তি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পেও ব্যাপক দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। এসব প্রকল্পে কাটমানি, ভুয়া বিল জমা দেয়া, ঠিকাদারদের সাথে সমঝোতা করে টাকার অঙ্ক লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।

বেবিচকের এই দুর্নীতির তদন্তে আরও জানা গেছে যে, হাবিবুর রহমান সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) ছিলেন এবং সেখানে ২১২ কোটি টাকার বিল পেছনে সুষ্ঠু কাজ ছাড়াই প্রদান করা হয়েছে। এরকম অসংখ্য দুর্নীতির ঘটনা দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। ২০১৯ সালে সরকার ঘোষিত থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করেও ১২শ কোটি টাকা সাশ্রয়ী করার কথা বলা হলেও এই টাকা কোথায় গেছে তা এখনও অনুসন্ধানাধীন।

একাধিক বিমানবন্দর প্রকল্পে এমন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর, বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, “মামলা হয়েছে, তবে এখনও একজনকে দোষী বলা যাবে না। তদন্তের পর যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।” কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যেহেতু দুর্নীতির প্রমাণ এসেছে এবং আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের হয়েছে, তাহলে কেন ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না?

এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই দুর্নীতির অনেক অংশই আড়াল করা হয়েছিল, যা এখনো কিছুটা বিস্মৃতির মধ্যে রয়েছে। তবে তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে এবং দুর্নীতির মাপ আরও বড় হচ্ছে। দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে যে, এই সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং সরকারি ফান্ডের অপব্যয় ঘটানো হয়েছে।

এদিকে, হাবিবুর রহমান নিজেকে অভিযুক্ত না হওয়ার দাবি করেছেন। তিনি বলছেন, তার আমলে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি এবং তিনি কোনও অবৈধ কাজ করেননি। তবে তার বিরুদ্ধে দুদক ইতোমধ্যে ৪টি মামলা দায়ের করেছে এবং তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছে, তাতে তিনি একমাত্র ব্যক্তি নন, বরং বেবিচকের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও অভিযুক্ত হয়েছেন।

এছাড়া, অনেক বেবিচক বোর্ডের সদস্য এবং পরিচালক তাকে সমর্থন জানাচ্ছেন, এমনকি তার ২ বছরের চুক্তি বাড়ানোর প্রস্তাবও রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে কি তাকে পদ থেকে সরিয়ে নেয়া হবে, নাকি শুধু তদন্ত প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবে? এতে দেশের জনগণ আবারও প্রশ্ন তুলেছে যে, ক্ষমতার আসনে বসে থাকা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কেন এত সহজে দমন করা সম্ভব হচ্ছে না।

দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন যে, ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার অপব্যয় ও দুর্নীতি হয়েছে এবং এর সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে, পরিস্থিতি এখনো স্থিতিশীল নয়, কারণ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ এখনও ফাঁকা জায়গায় জমা রয়েছে, যেখানে কোনো প্রকৃত কাজ হয়নি।

এছাড়া, দেশের আকাশযান পরিচালনা ব্যবস্থা ও বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়ন কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে, শুধু যে জনগণের স্বার্থেই তা হবে না, বরং দেশের অর্থনীতির জন্যও তা সহায়ক হবে। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই দুর্নীতির নায়ক-নায়িকাদের শাস্তি দেয়া, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আর না আসে।

এছাড়া, দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারের সতর্কতা ও স্বচ্ছতার ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। দুই হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি বা এরকম বিপুল অর্থের অপচয় কোনোভাবেই প্রশ্রয়যোগ্য নয়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments